আমাদের দেশের প্রকৃত কবিরা বরাবরই ছন্দ-সচেতন। তবুও দেখা গেছে প্রতিষ্ঠালাভের পর তাঁরা গদ্যকবিতা বেশি লিখেছেন। বৃদ্ধ বয়সে অনায়াস কাব্যচর্চা এবং তৎপূর্বে অর্জিত স্বীকৃতিতে ধস নামার ভয় নেই-এই ভাবনায় তাড়িত হয়ে তাঁরা তা করেছেন। আবিদ আনোয়ার-এর ক্ষেত্রে ঘটেছে তার উল্টোটা। মধ্যবয়সে অল্পবিস্তর গদ্যকবিতার চর্চা করলেও প্রবেশলগ্নে ও পরিণত বয়সে তিনি ছন্দোবদ্ধ কবিতা লিখেছেন। গত কয়েক বছরে রচিত এই বইয়ের কবিতাগুলোয় প্রকাশ পেয়েছে তাঁর ছন্দনৈপুণ্যের বহুমাত্রিকতা। অক্ষম গদ্যরীতিতে অনেক তরুণ ও নবীনের হাতে রচিত কবিতারূপী রচনাকে আবিদ আনোয়ার চিহ্নিত করেছেন 'এলো-পদাবলি' হিসেবে। এটি তাঁর হাতে তৈরি একটা নতুন শব্দবন্ধ যা প্রকৃত কবিতাসন্ধানী পাঠকদের আকৃষ্ট করেছে। আধুনিকতার সঙ্গে ছন্দের কোনো বিরোধ নেই। বাংলা কবিতায় আধুনিকতার সূচনাকারী কবিদের হাতে রচিত হয়েছে যৎসামান্য গদ্যকবিতা এবং আশ্চর্যের বিষয় রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর গদ্যকবিতা লিখেছেন সবচেয়ে বেশি। কিন্তু তিনি নন্দিত হয়ে আছেন তাঁর ছন্দোবদ্ধ রচনাকর্মের জন্যই। কবি বুদ্ধদেব বসু'র মতো প্রাজ্ঞজনের মতে: আধুনিকতার সঙ্গে ক্লাসিকতার সুষম মিশ্রণেই জন্ম নেয় তীব্রতম প্রসাদগুণসম্পন্ন মুগ্ধকর কবিতা। এই বইয়ের কবিতাগুলোয় রয়েছে সেই প্রসাদগুণ। সাম্প্রতিক কালে কবিতারূপী রচনার প্রাচুর্য দেখে যেসব পাঠক কবিতা থেকেই মুখ ফিরিয়ে নিয়েছেন তাঁরা প্রকৃত আধুনিক কবিতার স্বাদ পাবেন এই বইয়ের কবিতাগুলোয়। কবিতায় সামগ্রিক অবদানের জন্য ২০১২ সালে বাংলা একাডেমি পুরস্কারপ্রাপ্ত এই কবির কবিতার সঙ্গে যাঁরা পরিচিত তাঁরা সবাই জানেন: নবীন-প্রবীণ সকল সাহিত্যবোদ্ধাই কবি আবিদ আনোয়ার-এর রচনাকর্মকে উচ্চমূল্য দিয়েছেন তাঁদের লিখিত আলোচনায়। বাংলা একাডেমির পরিচালক ড. তপন বাগচী'র সম্পাদনায় প্রকাশিত 'বহুমুখি আবিদ আনোয়ার' বইটিতে মুদ্রিত হয়েছে সেসব আলোচনা। শওকত ওসমান, সৈয়দ আলী আহসান, শামসুর রাহমান, শীর্ষেন্দু মুখোপাধ্যায়, মোহাম্মদ মাহফুজউল্লাহ, ড. হুমায়ুন আজাদ, আবদুল্লাহ আবু সায়ীদ, ড. মাহবুব সাদিক প্রমুখ প্রবীণের সঙ্গে সে বইতে রয়েছে বাংলাদেশ ও পশ্চিমবঙ্গের বহু তরুণ ও নবীন লেখকের মুগ্ধতাপূর্ণ মূল্যায়ন যা কবি আবিদ আনোয়ারের কবিতার গুরুত্বকে নিঃসন্দেহে প্রকাশ করে। "তার কবিতার দ্বারা সংক্রামিত হওয়ার জন্যে দরকার অভিনিবেশী পাঠক সম্প্রদায় যারা চিত্রকল্পের শোভা ও ব্যঞ্জনা অনুধাবনে সমর্থ"-ড. হুমায়ুন আজাদের এমন মন্তব্যকে স্মরণে রেখে আবিদ আনোয়ার শিল্পরূপের সঙ্গে কোনো আপোস না-করেও ক্রমাগত প্রয়াস চালিয়েছেন কবিতাকে সহজবোধ্য করে তোলার। বর্তমান গ্রন্থের কবিতাগুলো তাঁর সেই প্রয়াসের শ্রেষ্ঠতম ফসল।
আবিদ আনোয়ার-এর জন্ম ১৯৫০ সালের ২৪ জুন কিশোরগঞ্জ জেলায় কটিয়াদী থানার চর আলগী গ্রামে। বাবা মোঃ আজিমউদ্দিন ও মা হাসিনা বেগম। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় থেকে রসায়ন শাস্ত্রে অনার্সসহ ১৯৭২ সালে এমএসসি এবং পরবর্তী কালো কেবল লেখক হওয়ার সুবাদেই বিশ্বব্যাংকের বৃত্তি পেয়ে যুক্তরাষ্ট্রের মিসৌরী বিশ্ববিদ্যালয়-কলাম্বিয়া থেকে ১৯৮৭ সালে রেকর্ড মার্কসহ সাংবাদিকতায় এমএ পাশ করেন এবং একাডেমিক কৃতিত্ব ও সাংবাদিকতা-সংক্রান্ত গবেষণার জন্য যুক্তরাষ্ট্রের ন্যাশনাল জার্নালিজম স্কলারশিপ সোসাইটি'র সম্মানসূচক সদস্যপদ লাভ করেন। কবিতা, প্রবন্ধ, ছড়া, গল্প ও গান রচনায় এবং সাহিত্য সমালোচনায় তিনি সমান পারদর্শী। প্রকাশিত বইয়ের সংখ্যা চৌদ্দ। বিজ্ঞানবিষয়ক লেখালেখির জন্য তিনি ১৯৭৯ সালে রাষ্ট্রপতি পদক, সাহিত্যকর্মের জন্য ১৯৯৬ সালে রাইটার্স-এর স্মারক পদক ও সংবর্ধনা, ১৯৯৭ সালে স্বাধীনতার রজত জয়ন্তি পুরস্কার (সৈয়দ নজরুল ইসলাম পদক) ও বৃহত্তর ময়মনসিংহ সমিতির সংবর্ধনা, ছড়া-সাহিত্যে অবদানের জন্য ২০০৬ সালে সুকুমার রায় সাহিত্য পুরস্কার এবং কবিতায় সামগ্রিক অবদানের স্বীকৃতিস্বরূপ ২০১২ সালে বাংলা একাডেমি সাহিত্য পুরস্কার পেয়েছেন। তাঁর রচিত ইংরেজি স্ক্রিপ্টনির্ভর অনুষ্ঠানের জন্য দুই-দুইবার (২০০৫ ও ২০০৮ সালে) বাংলাদেশ বেতার কমনওয়েলথ ব্রডকাস্টিং অ্যাসোসিয়েশন পুরস্কার পেয়েছে। অনেক জাতীয় ও আন্তর্জাতিক প্রতিষ্ঠানে চাকুরির শেষে তিনি বর্তমানে আন্তর্জাতিক উদরাময় গবেষণা কেন্দ্র, বাংলাদেশ (আইসিডিডিআর,বি)-র প্রকাশনা বিভাগে কনসালট্যান্ট এডিটর হিসেবে কর্মরত।