স্বাধীনতার পর ভারত যে রাষ্ট্রকাঠামোর স্বপ্ন দেখেছিল, তার কেন্দ্রে ছিল উদার গণতন্ত্র, ধর্মনিরপেক্ষতা এবং সামাজিক ন্যায়ের অঙ্গীকার। কিন্তু সাত দশক পেরিয়ে এ স্বপ্নের ভিতরেই তৈরি হয়েছে এক জটিল দ্বৈততা। বাহ্যিক কাঠামো আজও গণতান্ত্রিক নির্বাচন, সাংবিধানিক প্রতিষ্ঠান এবং আইনের ভাষ্য ধরে রাখে। কিন্তু একই সঙ্গে রাজনীতির গভীরে ক্রমে শেকড় গেড়েছে এমন এক মতাদর্শ, যার শক্তি আসে ধর্মীয় জাতীয়তাবাদ, সংখ্যাগরিষ্ঠতাবাদ এবং সাংস্কৃতিক আধিপত্য থেকে। এই দ্বৈত বাস্তবতার মধ্যেই তৈরি হয়েছে এক অদ্ভুত সহাবস্থান উদার গণতন্ত্রের প্রতিশ্রুতি আর চরম দক্ষিণপন্থার রাজনীতি পাশাপাশি চলে, কখনো প্রতিযোগিতায়, কখনো অবচেতন সমঝোতায়। আরএসএস ও বিজেপির মতো সংগঠনগুলোর দীর্ঘ সাংস্কৃতিক প্রস্তুতি, শৃঙ্খলাবদ্ধ সংগঠনিক শক্তি ও মতাদর্শিক প্রচার ভারতকে এমন এক পথে নিয়ে এসেছে, যেখানে রাষ্ট্রক্ষমতার কেন্দ্রে উঠে আসা সম্ভব হয়েছে ধর্মীয় পরিচয়নির্ভর রাজনীতির সাহায্যে। বিশ্বব্যাপী নয়া উদারনৈতিক পুঁজিবাদের যুগে এই উত্থান আরও দ্রুত হয়েছে। কর্পোরেট পুঁজি, নির্বাচনী প্রচারের বিপুল অর্থায়ন, এবং মিডিয়ার কাঠামোগত পক্ষপাত একত্রে এমন একটি রাজনৈতিক বাস্তবতা তৈরি করেছে, যা বাইরে থেকে দেখতে উদারতান্ত্রিক হলেও ভেতরে ক্রমশ কর্তৃত্ববাদী বৈশিষ্ট্য ধারণ করছে। উন্নয়নের ভাষায় লুকিয়ে থাকছে সাংস্কৃতিক একরৈখিকতার প্রচেষ্টা, আর জাতীয়তাবাদের আড়ালে ঘটে যাচ্ছে ভিন্নমত ও সংখ্যালঘু পরিচয়ের ক্রমাগত প্রান্তিকীকরণ। এই বইটি সেই পরিবর্তনের ধারাবাহিকতা, প্রক্রিয়া এবং বিপদের বিশ্লেষণ। এখানে তুলে ধরা হয়েছে কিভাবে একটি ধর্মনিরপেক্ষ রাষ্ট্রচিন্তা ধীরে ধীরে সরে এসেছে এক নতুন ধরনের গণতান্ত্রিক কর্তৃত্ববাদের দিকে। আলোচনা করা হয়েছে ক্ষমতার কাঠামোর পরিবর্তন, মিডিয়া ও কর্পোরেট জোট, সাংস্কৃতিক পুনর্গঠন, এবং নাগরিক পরিচয়ের রূপান্তর। পাঠক এখানে দেখতে পাবেন ফ্যাসিবাদের পুরনো রূপরেখা কীভাবে আজ নতুন ভাষা, নতুন প্রতীক এবং “উন্নয়ন” ও “জাতীয় গর্ব” এর উজ্জ্বল মুখোশ পরে ফিরে এসেছে। এই বই শুধু রাজনৈতিক বিশ্লেষণ নয়; এটি আমাদের সময়ের অন্তর্লীন সংকটকে বোঝার একটি গভীর বৌদ্ধিক প্রচেষ্টা। গণতন্ত্র বাঁচবে কিনা এই প্রশ্নের মুখোমুখি দাঁড়ানো আজকের ভারতকে বোঝার জন্য এই বই অপরিহার্য।