প্রকাশকের কথা
বিসমিল্লাহির রহমানির রাহিম
❝আমি কতদিন আলো-বাতাস দেখি না,আল্লাহর দুনিয়া দেখি না,ওরা আমাকে আযান শুনতে দেয় নাই। আমার এই গামছাটা তে আমি যেই পরিমাণ চোখের পানি মুছেছি,ওই পানি জমাইলে একটা দিঘি বানানো যেতো!❞
দীর্ঘ ৮ বছর পর "আয়নাঘর" নামক গোপন সামরিক কারাগার হতে মুক্ত হয়ে আত্নীয় পরিজনদের এই কথা গুলোই বলেছিলেন একজন মজলুম বন্দী।
এই ৮ বছরে তিনি কোন মানুষের চেহারা দেখতে পান নি,আয়নাঘরের প্রহরীরা যখনই আসতেন নিজেরা মাক্সে মুখ ঢেকে রাখতেন এবং বন্দীরও চোখ বেঁধে মুখে মুখোশ পরিয়ে দিতেন, প্রয়োজন অপ্রয়োজনে হাত বেঁধে রাখতেন।
৮ বছর সময়ে আনুমানিক ৪২ হাজার বার তার হাত এবং চোখ বাঁধা হয়েছে।
২ হাজার ৯ শত ৮ দিন বা প্রায় ৭০ হাজার ঘন্টা তিনি দুনিয়া থেকে বিচ্ছিন্ন এক বন্ধ কুঠুরিতে একাকী বন্দী ছিলেন, নির্জনতা তাকে কুড়ে কুড়ে খেয়েছে। সেই অত্যন্ত জরাজীর্ণ পরিবেশে ছাড়পোকা আর রোগ ব্যধির কষ্টই ছিলো তার নিত্যসঙ্গী।
পাঠক, আপনারা ভাববেন না আমি কোন ভয়ংকর অপরাধী বা খুনির কথা বলছি।আমি কোন দুর্নীতিবাজ, চাঁদাবাজ, ঘুষখোর, চোর, ডাকাত, লম্পট, খুনী, ধর্ষক বা দেশদ্রোহীর কথা বলছি না।
আমি বলছি তার কথা, যার সম্পর্কে বলা হয়,
"One of the finest and decorated amry officer of this country."
আর সেই মানুষটি হচ্ছেন, বাংলাদেশের ইতিহাসে অন্যতম সেরা দেশপ্রেমিক সেনা কর্মকর্তা ব্রিগেডিয়ার জেনারেল (অবঃ) আব্দুল্লাহিল আমান আযমী।তিনি জীবনের ৩০ টি বছর দেশমাতৃকার সেবায় নিজেকে উজাড় করে দিয়েছেন। কিন্তু তারপরও নিজ দেশে তাকে এরকম ভয়ংকর জুলুমের শিকার হতে হয়েছে। কারণ,তিনি ভারতের হাত থেকে বাংলাদেশের স্বাধীনতা - সার্বভৌমত্ব রক্ষায় আপোষহীন ছিলেন। তার আরেকটি অপরাধ, তিনি বাংলাদেশের ইসলামি আন্দোলনের প্রাণপুরুষ, বাংলাদেশ জামায়াতে ইসলামীর সাবেক আমির শহীদ অধ্যাপক গোলাম আযম (রহঃ) এর সন্তান। যার কারণে ভারত এবং ভারতের আজ্ঞাবহ আওয়ামী লীগ সরকার এই পরিবারের উপর সীমাহীন জুলুম,নির্যাতন চালায়।তার পিতা শহীদ অধ্যাপক গোলাম আযম (রহঃ) জীবনের শেষ দিন পর্যন্ত কারাগারে বন্দী থেকে আপোষহীনতার এক উজ্জ্বল দৃষ্টান্ত রেখে গেছেন।
ফ্যাসিবাদী সরকার প্রথমে বিনা অপরাধে,বিনা বিচারে ব্রিগেডিয়ার জেনারেল (অবঃ) আযমীকে চাকুরি হতে বরখাস্ত করে এবং পরে "আয়নাঘর" নামক ডিজিএফআইয়ের গোপন কারাগারে গুম করে রাখে।স্বৈরাচার সরকারের পতনের আগ-পর্যন্ত তিনি দীর্ঘ ৮ বছর সেখানে গুম অবস্থায় বন্দী ছিলেন।
গত ১৬ বছরের আওয়ামী দুঃশাসনে গুম,খুন,ধর্ষণের সকল মাত্রা ছাড়িয়ে গিয়েছিল। ফখরুদ্দিন-মঈনুদ্দিন এর ১/১১ সরকারের মাধ্যমে প্রতিষ্ঠিত আওয়ামী সরকারের সময় নির্মমতার কোন সীমা পরিসীমা ছিলো না। তারা নির্বিচারে ইসলামি আন্দোলনের নেতৃবৃন্দকে ফাঁসি দেয়।হাজার হাজার আলেম-ওলামা,সাধারণ মানুষকে তারা গুম, খুন করে। রাষ্ট্রের আইন শৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনী বন্দীর স্ত্রীকে রোজা ভাঙ্গিয়ে বারবার ধর্ষন করার মতো ভয়ংকর পাশবিক নির্যাতন পর্যন্ত করে। মূলত বিচারহীনতার সংস্কৃতিই দেশকে এমন অন্ধকারের দিকে নিয়ে যায়। আমাদের দাবি,নতুন বাংলাদেশে অতিতে ঘটে যাওয়া সকল অপরাধ ও জুলুমের বিচার করতে হবে।
এই বইতে আমরা সেই রকম লক্ষ লক্ষ মজলুমের একজন মজলুম ব্রিগেডিয়ার জেনারেল (অবঃ) আব্দুল্লাহিল আমান আযমীর দীর্ঘ যন্ত্রনাময় গুম জীবনের কথা গুলো শুনবো। বইয়ের পাতায় পাতায় অপশাসন আর মানবাধিকার হরনের নির্মম গল্প বর্নিত হয়েছে। লেখক এই বইতে কেবল নিজের কষ্টের কথাই বর্ননা করেন নি,পাশাপাশি বাংলাদেশের রাজনীতি ও সেনাবাহিনীর অনেক তাৎপর্যপূর্ণ অজানা ঘটনাও বর্ননা করেছেন। এবং সব শেষে দেশ যাতে আর কখনো বিপথগামী না হয় সেই লক্ষ্যে তার পরামর্শও দিয়েছেন।
বইয়ের একটি বিশেষত্ত্ব হচ্ছে, বইয়ের শেষ দিকে আমরা লেখকের স্ত্রীর বক্তব্য তুলে ধরেছি।প্রথমে, স্বামীকে চাকুরি থেকে বরখাস্ত করা হলো,তার কিছুদিন পর কারাগারে শ্বশুর শাহাদাত বরন করলেন, তার কিছুদিন পর স্বামীকে বাসা থেকে বাসা থেকে তুলে নিয়ে গুম করা হলো, কিছুদিন পর শাশুড়িও ইন্তেকাল করলেন। সেই কঠিন সময়ে দুটো শিশু সন্তান নিয়ে একজন নারী কিভাবে সব সামাল দিলেন সেই সংগ্রামের ছোট একটি চিত্র আমরা তুলে ধরেছি।
প্রিয় পাঠক, ব্রিগেডিয়ার জেনারেল (অবঃ) আব্দুল্লাহিল আমান আযমীর "বিভীষিকাময় আয়নাঘর : ফ্যাসিবাদের গোপন কারাগারে ২৯০৮ দিন" বইটি একটি নতুন ইতিহাস রচনার সূচনা বলতে পারেন।মহানগর পাবলিকেশন এই বাংলাদেশের জমিনে ঘটে যাওয়া জুলুমের চিত্র একে একে তুলে ধরবে ইনশাআল্লাহ। আমাদের আশা,পাঠক বইটি পড়ে যুগযুগ ধরে ফ্যাসিবাদের ভয়াবহতা সম্পর্কে জানতে পারবে,ফ্যাসিবাদের ব্যাপারে নিজে সচেতন হবে এবং অন্যকে সচেতন করবে,এবং সব সময় জুলুমের বিরুদ্ধে সোচ্চার থাকবেন, ইনশাআল্লাহ।মহানগর পাবলিকেশন এর এই দুঃসাহসিক যাত্রায় আমরা মহান আল্লাহর সাহায্য এবং দেশবাসীর দোয়া-সমর্থন চাই।আসসালামু আলাইকুম।
তৌহিদুল মিনহাজ।