গৃহীর ঠাকুর শ্রীরামকৃষ্ণ
শ্রীরামকৃষ্ণ যত না ছিলেন সন্ন্যাসীর তার চেয়ে বড় ঢের বেশি ছিলেন গৃহীর । গৃহীকে আদর্শ গৃহী করার জন্যই তাঁর আবির্ভাব। গৃহ-দুর্গে বসে অহরহ জগন্ময়ী চিন্ময়ীর স্মরণমনন করতে করতে পরমপদে লীন হয়ে যাও—আমাদের জন্য এই ছিল তাঁর বাণী। কথামৃতকার শ্রীম যখন প্রথম তাঁর কাছে গেলেন, সে এক অবিস্মরণীয় সাক্ষাৎকার। প্রথম দিনটিতে মাত্র দুটি কথা। সসঙ্কোচে শ্রীম জিজ্ঞেস করছেন, ‘আপনি এখন সন্ধ্যা করবেন, তবে এখন আমরা আসি।' ঠাকুর ভাবে ছিলেন। সূর্যাস্ত হয়ে গেছে।
সন্ধ্যা সমাগত। এই সান্ধ্যক্ষণে ঠাকুর কখনও এ-জগতে কখনও ও-জগতে। শ্রীমর প্রশ্নে তাঁর ভাবান্তর হলো। তিনি থেমে থেমে বললেন—‘না—সন্ধ্যা–তা এমন কিছু নয়।' লক্ষণীয়, ঠাকুর লোকদেখানো কোনও অনুষ্ঠান করতেন না। কোনও ভড়ং ছিল না; তিনি গুরু হতে চাননি। আমরা তাঁকে গুরু করে নিতে বাধ্য হয়েছি—যেমন শ্বাসে আমাদের বাতাস নিতেই হয়, তা না হলে আমরা হাঁপিয়ে উঠি; মৃত্যুর ভাব হয়। তাঁর গেরুয়া ছিল না। ছিল না মালাচন্দন। ‘সন্ধ্যা যাঁর সন্ধানে ফেরে' তাঁর আবার আনুষ্ঠানিক সন্ধ্যার কী-বা প্রয়োজন? তিনি তো পার্ট-টাইম সাধক ছিলেন না, তিনি ছিলেন ফুলটাইমার। অদ্বৈত জ্ঞানটি আঁচলে বাঁধা ছিল তাঁর। মায়ের কোলেই তিনি বসে থাকতেন।
সাজ-সজ্জায় তিনি সাধারণ একজন বাঙালি গৃহী। কালো গলাবন্ধ কোটটি পরে যখন দাঁড়াতেন তখন কোনও ভাবেই মনে হতো না যে তিনি আমাদের থেকে পৃথক। গৃহীর উজ্জ্বল মূর্তিটি আমাদের সামনে তুলে ধরে ঠাকুর বলতে চেয়েছিলেন, ‘ঘাবড়াও মৎ।’‘গয়াগঙ্গা প্রভাসাদি, কাশী, কাঞ্চি, কেবা চায় !” ত্রিসন্ধ্যা কালী বলে যাও।
দ্বিতীয় সাক্ষাৎটি বড় সুন্দর। সেইদিন আলাপ অনেক গভীরে গেল। প্রথম দিনের ভয় আর সঙ্কোচ কাটাতে পেরেছেন মাস্টার মহাশয়। ঠাকুরও এই আগ্রহী, সৌম্য মানুষটিকে জানতে চান, কারণ শ্রীমকে দিয়ে তিনি বিশাল একটি কাজ করাবেন, শ্রুতিলিখন। ঠাকুর শ্রীম'র প্রাথমিক পরিচয় নিলেন। যেন চাকরির দরখাস্ত পূরণ করাচ্ছেন। হঠাৎ ঠাকুর জিজ্ঞেস করলেন, ‘তোমার কি বিবাহ হয়েছে?' মাস্টার বললেন, 'আজ্ঞে হাঁ। ঠাকুর যেন ধাক্কা খেলেন। আশা ভঙ্গ হলো তাঁর।