গীতাঞ্জলি (Gitanjali) রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের এক অনন্যসাধারণ কাব্যসংকলন, যা মূলত প্রার্থনামূলক ও আধ্যাত্মিক ভাবসম্পন্ন কবিতার সমষ্টি। এই বইটি প্রথম প্রকাশিত হয় ১৯১০ সালে বাংলা ভাষায়, এবং পরে ইংরেজিতে অনুবাদ করেন কবি নিজেই, যার জন্য তিনি ১৯১৩ সালে সাহিত্যে নোবেল পুরস্কার লাভ করেন — যা ছিল এশিয়ার প্রথম নোবেল।
📚 গীতাঞ্জলির সারমর্ম:
আধ্যাত্মিকতা ও ঈশ্বরভক্তি: গীতাঞ্জলির মূল সুর হলো ঈশ্বরভক্তি ও আত্মোপলব্ধি। কবি তাঁর আত্মার গভীর থেকে ঈশ্বরের প্রতি প্রেম, নিবেদন ও সমর্পণের কথা বলেছেন। এটি কোনো গোষ্ঠীবদ্ধ ধর্মের নিগড়ে বাঁধা নয়; বরং এক সর্বজনীন ঈশ্বর-অনুসন্ধান।
মানবতা ও জীবনচেতনা: রবীন্দ্রনাথ ঈশ্বরকে খুঁজেছেন মানুষের মধ্যে, প্রকৃতির মাঝে, শ্রমজীবী মানুষের ঘামে। তাঁর ঈশ্বর বন্দির মধ্যে নয়, বরং কর্মের মধ্যে, মানবসেবার মধ্যে, জীবনের প্রতিটি মুহূর্তে।
নম্রতা ও বিনয়: কবিতাগুলোতে এক অনবদ্য বিনয়বোধ দেখা যায়, যেখানে কবি বারবার নিজের ক্ষুদ্রতা ও ঈশ্বরের মহত্ত্ব স্বীকার করেছেন। এই বিনয় থেকেই ঈশ্বরের প্রতি গভীর অনুরাগ সৃষ্টি হয়েছে।
সৌন্দর্য ও সংগীত: রবীন্দ্রনাথ তাঁর গীতিময় ভাষা, চিত্রময় রূপক ও সংগীতধর্মী ছন্দে ঈশ্বরের প্রতি প্রেম ও মানুষের জীবনের গভীর অনুভূতি প্রকাশ করেছেন।
🎵 গীতাঞ্জলি একটি আত্মার সুর:
এটি শুধুমাত্র কবিতার সংকলন নয়, এক প্রার্থনার ডায়েরি — যেখানে কবি নিজের আত্মাকে উজাড় করে দিয়েছেন ঈশ্বরের কাছে। প্রতিটি কবিতা যেন একেকটি গীত, একেকটি ধ্যানমন্ত্র।
রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের জন্ম ১৮৬১ সালের ৭ মে (২৫ বৈশাখ ১২৬৮) কলকাতার জোড়াসাঁকোয়। বাবা মহর্ষি দেবেন্দ্রনাথ। বিংশ শতাব্দীর শ্রেষ্ঠ ভারতীয় মনীষী এবং বিশ্ববিখ্যাত কবি। ছাপার অক্ষরে স্বনামে তাঁর প্রথম প্রকাশিত কবিতা ‘হিন্দু মেলার উপহার’ (৩০.১০.১২৮১ ব.)।
১৮ বছর বয়সের মধ্যে তিনি ‘বনফুল’, ‘কবিকাহিনী’, ‘ভানুসিংহের পদাবলী’, ‘শৈশব সংগীত’ ও ‘রুদ্রচণ্ডু’ রচনা করেন। ‘জ্ঞানাঙ্কুর’ পত্রিকায় প্রকাশিত ‘ভুবনমোহিনী প্রতিভা’ তাঁর প্রথম গদ্য প্রবন্ধ। ‘ভারতী’র প্রথম সংখ্যায় তাঁর প্রথম ছোটগল্প ‘ভিখারিণী’ এবং প্রথম উপন্যাস ‘করুণা’ প্রকাশিত হয়। ২২ বছর বয়সে নিজেদের জমিদারি সেরেস্তার এক কর্মচারীর একাদশবর্ষীয়া কন্যা ভবতারিণীর (পরিবর্তিত নাম মৃণালিনী) সঙ্গে তাঁর বিবাহ হয় (৯.১২.১৮৮৩)। পুত্র রথীন্দ্রনাথের শিক্ষা-সমস্যা থেকেই কবির বোলপুর ব্রহ্মচর্য আশ্রমের সৃষ্টি হয় (২২.১২.১৯০১)। সেই প্রতিষ্ঠানই আজ ‘বিশ্বভারতী বিশ্ববিদ্যালয়’-এ রূপান্তরিত হয়েছে।
১৯১২ সালের নভেম্বর মাসে গীতাঞ্জলির ইংরেজি অনুবাদ বা ‘ঝড়হম ঙভভবৎরহমং’ প্রকাশিত হয়। ১৯১৩ সালের অক্টোবরে প্রথম ভারতবাসী রবীন্দ্রনাথ সাহিত্যে নোবেল পুরস্কার লাভ করেন। কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয় তাঁকে ডক্টরেট (১৯১৪) এবং সরকার স্যার (১৯১৫) উপাধিতে ভূষিত করে।
রবীন্দ্রনাথের একক চেষ্টায় বাংলাভাষা সকল দিকে যৌবনপ্রাপ্ত হয়ে বিশ্বের দরবারে সগৌরবে নিজের আসন প্রতিষ্ঠা করেছে। কাব্য, ছোটগল্প, উপন্যাস, নাটক, প্রবন্ধ, গান প্রত্যেক বিভাগেই তাঁর অবদান অজস্র এবং অপূর্ব। তিনি একাধারে কবি, দার্শনিক, শিক্ষাবিদ, সুরকার, নাট্যপ্রযোজক এবং স্বদেশপ্রেমিক। তাঁর রচিত দুই হাজারের ওপর গানের স্বরলিপি আজো প্রকাশিত হচ্ছে। দুটি স্বাধীন রাষ্ট্রের (ভারত ও বাংলাদেশ) জাতীয় সংগীত-রচয়িতারূপে একমাত্র রবীন্দ্রনাথেরই নাম পাওয়া যায়।