অঘোরপন্থীরা নানা যোগবিভূতি জানেন। অঘোরীরা যেমন শক্তির উপাসক হন, সাধন ভেদে তাঁরা শিবেরও উপাসনা করে থাকেন। শৈবপন্থী অঘোরীরা হাড়ের মালার সঙ্গে শিব – শক্তির প্রতীক হিসেবে রুদ্রাক্ষের মালাও ধারণ করেন।
অঘোরী কথার অর্থ, যার ঘোর কেটে গেছে। অঘোরান্ন পরো মন্ত্র ; অঘোর মন্ত্রের পর আর কোনও মন্ত্র নেই । তন্ত্রমতে অঘোরপন্থী সাধনাই শ্রেষ্ঠ সাধনা। চিরবিরাজমান মৃত্যুর ক্ষেত্র শ্মশান। শ্মশানই অঘোরীর সাধনার প্রধান ক্ষেত্র। সমগ্র বিশ্বব্রহ্মাণ্ডকেই অঘোরীসাধক শ্মশানভূমি হিসেবে দেখেন। মৃত্যুকে তাঁরা স্বতন্ত্ররূপের ভেতর নিয়ে এসে পুজো করে থাকেন। কুলকুণ্ডলিনীকে তাঁরা জাগিয়ে স্থূলশরীরের একেবারে মৃত্যু ঘটিয়ে সূক্ষ্মশরীরের ভেতর সমগ্র বিশ্বব্রহ্মাণ্ডকে উপভোগ করেন। অঘোরী সাধুরা বলেন, শ্বাসই গুরু। শ্বাসের ভেতর ঊনপঞ্চাশ বায়ুর চলাচল। সব বায়ু থেমে যায় প্রাণবায়ু স্থির হলে। মনের চঞ্চল দিক অজ্ঞান। স্থির দিক জ্ঞান। স্থির না হলে সাধনা কী করে হবে? দেহের মধ্যকার চঞ্চল প্রবাহ অন্ধকারের দিক। গুরু এসে বায়ু চেনাবেন। বায়ু চিনলে অন্তর্মুখী প্রাণকর্ম হবে। ওই কাজেই জ্ঞান মিলবে। গুরুর সাহায্য ছাড়া এক পাও এগোনো চলে না অঘোর পথে। অঘোরীরা বৈনাশিক রূপের সাযুজ্য নিয়ে মাতেন বলে শ্মশানে শবদেহের ওপর বসে সাধনা করেন, মড়ার মাথায় খাদ্যবস্তু গ্রহণ করেন, নানান সব বীভৎস আচরণ করেন। অঘোরতন্ত্রে খণ্ডমণ্ড যোগ একটি সাধনক্রিয়া। কূর্ম অর্থাৎ কচ্ছপের মতন হাত পা গুটিয়ে সাধন – আসনে বসতে হয়। সাধনায় ইন্দ্রিয়কে আলাদা করতে হয় দেহ থেকে। দেহের বিশেষ উত্তেজক অংশকে অঘোরী সাধুরা একেবারে অবশ ও অসাড় করে রাখেন। যা বাদের পর্যায়ে পড়ে। অনেক সাধু অঘোরবিদ্যাতে মাথা কেটে ফেলার মতন অতীব লোমহর্ষক কাহিনি বলে জনগণকে ভিরমি খাওয়ান । অঘোরীদের ডেরায় ডেরায় ঘুরে বেরানো আর হরেক কিসিমের সন্ত – যোগিনীদের নিয়ে লেখা এই বইয়ের একুশটি আখ্যান ও অঘোর গবেষক ডক্টর সিজলানাথ অঘোরীর লেখা মূল্যবান পাঁচটি চিঠিপত্রের ভেতর দিয়ে প্রস্ফুটিত হয়েছে অঘোরসাধনার সম্পূর্ণ ইতিবৃত্ত। অঘোরীদের শব – শ্মশান ও চিতাসাধনা, জীবনযাপন, যোগপ্রণালী, অঘোর তন্ত্রের প্রয়োগ ও সিদ্ধাই, অঘোর ধ্যান, কায়াসাধনা, খাওয়া দাওয়া, নেশাবস্তু থেকে শুরু করে যাবতীয় টুকিটাকি ধরে রাখা গেছে বৃহত্তর এই অঘোরী বৃত্তান্তে। সব মিলিয়ে অঘোরীদের ডেরায় বইখানি হয়ে উঠেছে ভারতবর্ষের অঘোরীদের ইতিহাস ও সাম্প্রতিক অঘোরসাধনার বাস্তবিক চিত্র । অঘোরীদের সঙ্গে দীর্ঘকালীন একত্রবাসের অত্যাশ্চর্য, বিস্ময়বোধক প্রামাণ্য কথিকা ।