এই প্রশ্ন যদি করা হয় তাহলে হয়তো অধিকাংশ খ্রিষ্টানই বাইবেলের ভূমিকায় দেয়া বক্তব্য থেকে গদবাধা উত্তর দেয়ার চেষ্টা করবেন। তারা হয়তো উত্তর দিবেন মানুষই বাইবেল রচনা করেছে, তবে নিজ থেকে রচনা করেনি বরং পবিত্র আত্মার দ্বারা (হযরত জিব্রাইল) অনুপ্রাণীত হয়েই রচনা করেছে। সুতরাং বাইবেল মূলত স্রষ্টারই লেখা গ্রন্থ। বাইবেলের ব্যাখ্যা কারকরা মাঝেমধ্যে স্বীকার করে নেন যে বাইবেলে কিছু সংযোজন বিয়োজন হয়েছে তবে তা অসৎ উদ্দেশ্যে করা হয়নি বরং বাইবেলকে সহজবোধ্য করে মানুষের মাঝে উপস্থাপন করার জন্যই করা হয়েছে। যাতে সাধারন মানুষ সহজ ও সাবলীল ভাষায় বাইবেল পাঠ করতে পারে।
আবার কখনো কখনো তারা এই বলে পাঠককে সতর্ক করে দেন যে, কিছু বিষয় সঙ্গত কারনেই বাইবেলের পুরনো বাণীর সাথে সংযোজিত হয়েছে। তবে এই সংযোজিত বিবরনগুলো বাইবেলের মূল বক্তব্যের সাথে কোনো বিরোধ তৈরী করে নি, বরং পুরোনো বাণীকে শক্তিশালী করেছে। এই পরিবর্তন পরিবর্ধন নিয়ে শুধু পাদ্রীগনই কথা বলার অধিকার রাখেন। তারা গীর্জার অনুসারীদের এটা বুঝাতে সক্ষম হয়েছেন যে পাদ্রীগন নিজ থেকে কিছু করেন নি বরং পবিত্র আত্মার সাহায্য নিয়েই সংযোজন বিয়োজন করেছেন।
চতুর্থ শতাব্দীতে কাউন্সিল করার মাধ্যমে গীর্জা কর্তৃপক্ষ চারটি বাইবেলের তালিকা করে দেয়, এগুলোকে অনুমোদিত বাইবেলে বা ক্যাননিক গসপেল বলা হয়। ১৪৪১ সালে কাউন্সিল অব ফ্লোরেন্স, ১৫৪৬ সালে কাউন্সিল অব ট্রেন্ট এবং ১৮৭০ সালের প্রথম ভ্যাটিক্যান কাউন্সিল করার মাধ্যমে এই অনুমোদনকে আরো জোরালো করা হয়। পোপ কর্তৃক অনেকগুলো সংশোধনীর পর অতি সম্প্রতি দ্বিতীয় ভ্যাটিকান কাউন্সিল ঐশীবাণীর একটি টেক্সট প্রকাশ করেছে, যা খুবই গুরুত্বপূর্ণ। আর এটি তৈরি করতে দীর্ঘ তিন বছর (১৯৬২-১৯৬৬) কঠোর পরিশ্রম করতে হয়েছে। বাইবেলের বেশিরভাগ পাঠকই পাদ্রীদের কথা বিনা বাক্যব্যয়ে মেনে নেন। তারা বাইবেলের ভূমিকায় লেখা কথা গুলোকে পুরোপুরি বিশ্বাস করে নেন, তারা চিন্তাও করতে পারেন না যে এখানে সংকলকদের নিজস্ব চিন্তা চেতনার অনুপ্রবেশ ঘটেছে।
পাদ্রী সহ চার্চের প্রভাবশালী ব্যক্তিবর্গের এমন অনেক রচনা রয়েছে যেগুলো সর্বসাধারনের জন্য কখনো বই আকারে প্রকাশ করা হয়নি। এই ব্যাপারগুলো নিয়ে আলাপ করলে বুঝা যায় যে বাইবেলের বিভিন্ন সংস্করণের সত্যতার বিষয়টি যতটা জটিল মনে করা হয় তারচেয়েও অনেক বেশি জটিল। উদাহরণস্বরূপ আধুনিক বাইবেলের ফরাসি অনুবাদের কথা বলা যেতে পারে। এটি জেরুজালেমের বাইবেলিক স্কুলের তত্ত্বাবধানে অনুদিত হয়েছে এবং কয়েকটি খন্ডে প্রকাশিত হয়েছে। এই অনুবাদগুলো পড়লে এগুলোর প্রকাশভঙ্গির ভিন্নতা সুস্পষ্টভাবে পরিলক্ষিত হয়। আধুনিক অনুবাদগুলো পর্যবেক্ষন করলে বুঝা যায় যে ওল্ড টেস্টামেন্টের অধিকাংশ অধ্যায়গুলোও নিউ টেস্টামেন্টের মতোই বিতর্কিত বিষয়ের কারণে সমস্যায় জর্জরিত। আর এতে গ্রন্থকার নিজের অনেক ব্যাখ্যা জুড়ে দিয়েছেন। এ বিষয়ে পরবর্তিতে আরো গবেষণা করা হয়েছে যেখানে নতুন নতুন অনেক বিশ্বাসযোগ্য তথ্য পেয়েছি।
বইটি পড়লে বাইবেল কুরআন এব বিজ্ঞান সম্পর্কে জানতে পারবেন।
ড. মরিস বুকাইলি ১৯২০ সালের ১৯ জুলাই ফ্রান্সে জন্মগ্রহণ করেন। পেশায় তিনি একজন চিকিৎসক। ফ্রেঞ্চ সোসাইটি অব ইজিপ্টোলজির (মিশরত্ত্ব) সদস্য এই চিকিৎসক একজন গ্যাস্ট্রোএন্টারোলজি বিশেষজ্ঞও ছিলেন। বিশ্বজুড়ে তিনি একজন প্রসিদ্ধ চিকিৎসক হিসেবে খ্যাতি অর্জন করেছেন। তিনি সৌদি বাদশা ফয়সাল বিন আব্দুল আজিজের পারিবারিক চিকিৎসক হিসেবে নিযুক্ত হন ১৯৭৩ সালে। মিশরের তৎকালীন প্রেসিডেন্ট আনোয়ার সাদাত ও তাঁর পরিবারের সদস্যরাও ড. বুকাইলির কাছে চিকিৎসাসেবা নিয়েছেন। তিনি মেডিসিন চর্চা করেছেন ১৯৪৫ সাল থেকে ১৯৮২ সাল পর্যন্ত। তবে তাঁর কর্মজীবন শুধু চিকিৎসা জগতেই সীমাবদ্ধ নয়, নাম কুড়িয়েছেন একজন প্রসিদ্ধ গবেষক হিসেবেও। মরিস বুকাইলি ধর্ম ও বিজ্ঞানের মাঝে বিদ্যমান সম্পর্কের একজন একনিষ্ঠ গবেষক ছিলেন। তাঁর গবেষণার মূল বিষয়বস্তু ছিল ধর্ম, বিশেষত ইসলাম এবং আধুনিক বিজ্ঞানের মাঝে বিদ্যমান সম্পর্কগুলোর বাস্তবধর্মী বিশ্লেষণ। এই গবেষণা চলাকালে তিনি বিংশ শতাব্দীতে আবিষ্কৃত বেশ কিছু বৈজ্ঞানিক মতবাদ ও পদ্ধতির সাথে কোরআনে উল্লেখিত বক্তব্যের সাদৃশ্য দেখতে পান। অতঃপর প্রকাশিত হয় মরিস বুকাইলির বই ‘বাইবেল, কুরআন এন্ড সায়েন্স’। এই বইয়ে তিনি দেখান যে, কোরআন একটি ঐশ্বরিক গ্রন্থ, যাতে বৈজ্ঞানিকভাবে সঠিক তথ্য রয়েছে। এই মতবাদ থেকে জন্ম নেয় ‘বুকাইলিজম’ বা বুকাইলিবাদ। ড. মরিস বুকাইলি এর বই সমগ্র বিশ্বব্যাপী সাধারণ পাঠক ও গবেষকদের কাছে বেশ জনপ্রিয়তা লাভ করেছে। ১৯৭৬ সালে প্রকাশিত ‘বাইবেল, কুরআন এন্ড সায়েন্স’ বিশ্বের প্রায় ১৭টি ভাষায় অনূদিত হয়েছে। আরো প্রকাশিত ড. মরিস বুকাইলি এর বই সমূহ হলো ‘দ্য কুরআন এন্ড মডার্ন সায়েন্স’, ‘হোয়াট ইজ দ্য অরিজিন অব ম্যান’, ‘মাম্মিজ এন্ড ফারাওজ: মডার্ন মেডিকেল ইনভেস্টিগেশনস’ ইত্যাদি। মরিস বুকাইলির রচিত বইগুলোর বেশিরভাগই ফরাসি ভাষায় লেখা, তবে ইংরেজিতেও তাঁর রচনা আছে। প্রখ্যাত এই লেখক, গবেষক ও চিকিৎসক ১৯৯৮ সালের ১৭ ফেব্রুয়ারি পরলোকগমন করেন।