কেদার রাজা উপন্যাসের কেন্দ্রীয় চরিত্র কেদার। রাজা: তিনি গড়শিবপুর রাজবংশের এক উত্তরসূরী। কিন্তু রাজপাট ও ধন-সম্পদে প্রচুর অধিকার থাকলেও তিনি অহংকার বা রাজত্বের দম্ভ থেকে অনেকটাই মুক্ত একজন ব্যক্তি। কেদার রাজার একমাত্র সন্তান, বিধবা মেয়ে শরৎসুন্দরী, বিনি সুন্দরী, সরল, মমত্বপূর্ণ ও আত্মমর্যাদায় ভরা এক তরুণী। গ্রামের জীবন, প্রকৃতি-পরিবেশ ও প্রাচীন-কিংবদন্তির মিশেলে উপন্যাসটি গড়া।
গল্প শুরু হয় গ্রামীণ শান্তিপূর্ণ পরিবেশ থেকে, যেখানে কেদার রাজা ও শরৎ মিলে জীবন যাপন করেন। তবে শহরের কিছু দুর্বৃত্ত বা কৌশলী লোক কেদার রাজা ও তাঁর মেয়ের জীবনে হঠাৎ অবাঞ্ছিত। পরিবর্তন আনতে শুরু করে। প্রভাস নামের শহুরে পুরুষের সঙ্গে শরতের এক সম্পর্ক তৈরি হয়, যা কেবল প্রেম নয়, তার সঙ্গে শহরের অভিজাত জীবনের আকর্ষণ ও প্রলোভনও জড়িয়ে পড়ে। প্রভাসের চরিত্রে শহুরে জীবন, বিকাশ, অহঙ্কার ও অসাধারণ কৌশলময়তার উপাদান আছে।
শরৎ শহুরে প্রভাস-এর কথায় ও প্রলোভনে কিছুটা আকৃষ্ট হয়, কিন্তু তার মন, আদর্শ ও সরলতা একসময় প্রভাসের প্রকৃত চরিত্র ও উদ্দেশ্য বোঝে। প্রভাসের আচরণ ও উদ্দেশ্যে প্রকৃতির অমায়িকতা, গ্রামের সাদাসিধে জীবন, আত্মসম্মান ও সত্যিকার সম্পর্কের মান আরও স্পষ্ট হয়ে ওঠে। কেদার রাজা নিজের মেয়ের নিরাপত্তা ও মর্যাদার জন্য এবং প্রভাসের প্রভাব থেকে শরৎকে রক্ষা করতে চান, কিন্তু তার একান্ত ভালোবাসা-মমতুও মেয়ের স্বাধীনতা ও বিবেককে সম্মান করতে বাধ্য করে।
গল্পে অতিপ্রাকৃত বা অলৌকিক দিকও আছে-বিশেষ করে যখন ঘটনাগুলো বাস্তব ও অলৌকিকের সীমা ছুঁয়েছে। উপন্যাসটি শেষ হয় এমন এক পর্যায়ে যেখানে শরৎ প্রকৃতির মধ্য দিয়ে নিজের পথ খোঁজে, নিজেকে প্রতিষ্ঠা করে এবং শহরের মায়াজালের বাইরে নিজেদের জীবনকে নতুনভাবে শুরু করার ইচ্ছা প্রকাশ পায়। কেদার রাজার নিজেকেও মেয়ের পরিচ্ছন্ন জীবন ও সত্যিকারের ভালোবাসার মূল্য বুঝতে শেখা হয়।
বাংলা সাহিত্যের অন্যতম পথিকৃৎ বিভূতিভূষণ বন্দ্যোপাধ্যায় বেশ কিছু কালজয়ী উপন্যাস রচনার মাধ্যমে জয় করে নিয়েছেন বাংলা ভাষাভাষী পাঠকদের হৃদয়। শুধু উপন্যাসই নয়, এর পাশাপাশি তিনি রচনা করেছেন বিভিন্ন ছোটগল্প, ভ্রমণকাহিনী, দিনলিপি ইত্যাদি। প্রখ্যাত এই সাহিত্যিক ১৮৯৪ সালের ১২ সেপ্টেম্বর ভারতের পশ্চিমবঙ্গের চব্বিশ পরগণা জেলায় জন্মগ্রহণ করেন, তবে তাঁর পৈতৃক নিবাস ছিল যশোর জেলায়। অত্যন্ত মেধাবী ছাত্র হিসেবে তিনি শিক্ষাজীবন অতিবাহিত করেন, যার প্রমাণ পাওয়া যায় তাঁর প্রথম বিভাগে এনট্রান্স ও আইএ পাশ করার মাধ্যমে। এমনকি তিনি কলকাতার রিপন কলেজ থেকে ডিস্টিংশনসহ বিএ পাশ করেন। সাহিত্য রচনার পাশাপশি তিনি শিক্ষকতার মাধ্যমে কর্মজীবন অতিবাহিত করেন। বিভূতিভূষণ বন্দ্যোপাধ্যায় এর বই সমূহ এর মধ্যে সবচেয়ে বিখ্যাত হলো 'পথের পাঁচালী', যা দেশ ছাড়িয়ে বিদেশের মাটিতেও ব্যাপক জনপ্রিয়তা লাভ করেছে বিভিন্ন ভাষায় অনূদিত হওয়ার মাধ্যমে। এই উপন্যাস অবলম্বনে চলচ্চিত্র নির্মাণ করে প্রখ্যাত চলচ্চিত্রকার সত্যজিৎ রায় অর্জন করেছেন অশেষ সম্মাননা। বিভূতিভূষণ বন্দ্যোপাধ্যায় এর বই এর মধ্যে আরো উল্লেখযোগ্য কয়েকটি হলো 'আরণ্যক', 'অপরাজিত', 'ইছামতি', 'আদর্শ হিন্দু হোটেল', 'দেবযান' ইত্যাদি উপন্যাস, এবং 'মৌরীফুল', 'কিন্নর দল', 'মেঘমল্লার' ইত্যাদি গল্পসংকলন। ১০ খণ্ডে সমাপ্ত ‘বিভূতি রচনাবলী’ হলো বিভূতিভূষণ বন্দ্যোপাধ্যায় এর বই সমগ্র, যেখানে প্রায় সাড়ে ছ’হাজার পৃষ্ঠায় স্থান পেয়েছে তার যাবতীয় রচনাবলী। খ্যাতিমান এই সাহিত্যিক ১৯৫০ সালের ১ নভেম্বর বিহারের ঘাটশিলায় মৃত্যুবরণ করেন। সাহিত্যে অসামান্য অবদানের জন্য তিনি মরণোত্তর 'রবীন্দ্র পুরস্কারে' ভূষিত হন।