সৃষ্টি স্থিতির কোনো পর্বে পৃথিবীতে করোনা ছাড়া আর দ্বিতীয় কোনো রোগের সন্ধান মেলে না যে অসুখে আনুপাতিক হারে ডাক্তার আর নার্সের মৃত্যু হয়েছে সবচেয়ে বেশি । করোনা অপ্রকৃত সময়ে হাসপাতালে ডিউটি করা ক'জন ডাক্তারের বিঘ্নময় যাপিত জীবন নিয়ে গড়ে উঠেছে এই উপন্যাসের আঙ্গিক। তবে এই রচনার মূল গাঁথুনির সর্জন হয়েছে ডা. অভিজিৎ ও ডা. স্বপ্না নামের দু'জন জুনিয়র ডাক্তারকে ঘিরে। করোনা অবিহিতকালে এই দু'জনের জীবনের প্রাত্যহিকীই এই রচনার মূল প্রৈতি। এই উপন্যাসের যাবতীয় আলো পড়ে এই দুই ডাক্তারের ওপর, প্রতি পর্বেরই অবধারিত কুশীলব এরা দু'জন। কাহিনির চলমানতার জন্যে অভিজিৎ আর স্বপ্নার সাথে এসেছে অন্য পার্শ্বচরিত্রগুলো। ঢাকা মেডিকেল কলেজের সেরা ছাত্রদের একজন অভিজিৎ সেন, কিন্তু পেশাগত জীবনে অদৃষ্ট তার পক্ষে ছিলো না । চাকরি করতে সে যেখানেই গেছে দুর্গ্রহ তার পিছু ছাড়েনি, অশ্লেষা যোজিত নিয়তি তাকে সেখানেই অষ্টেপৃষ্ঠে-ললাটে অর্গলিত করে ফেলেছে। সরকারি চাকরিতে ছোট্ট একটা ভুলের মাশুল তাকে দিতে হয়েছে নিদারুণভাবে। এরপর যেখানেই সে চাকরি করতে গেছে সেখানেই সে প্রতারিত হয়েছে ভিন্ন ভিন্ন কারণে, কখনো ভুয়া করোনা রিপোর্ট স্বাক্ষর করার দায়ে, কখনো বিদেশগামী যাত্রীদের কোভিড টেস্ট রিপোর্ট নিয়ে সিন্ডিকেট ব্যবসায় বাধা দেয়ার কারণে আবার কখনো নিৰ্বিবেক বর্ণচোরা হাসপাতাল মালিকদের চোরাবালিতে পা দিয়ে। অনেকেই কোভিড ভাইরাসকে শিখণ্ডী বানিয়ে ছলে-বলে-কৌশলে মানুষের মৃত্যু নিয়ে ছেলেখেলা শুরু করে দিয়েছে এই কালবেলায় । অভিজিৎ নামের এই ডাক্তারটি সতত সত্যবাক্ আর ঋতবান থাকার সদ্গুণের কারণে, নিজেই নিজের জীবনকে বিপদগর্ভ করে তুলেছে বারবার। তাই দুর্দৈব আর ভাগ্যবিপর্যয়ের কূটবন্ধ থেকে বেরুতে পারেনি কখনো। কারো কারো প্রতি ভবিতব্য বড়ো রূঢ় হয়, লঘু পাপে নেমে আসে গুরুদণ্ডের খড়গ। যেমনটা ঘটেছিল ডা. অভিজিতের বেলায় ।
যুদ্ধক্ষেত্রে প্রতিটি সৈনিকের একটা ঝুঁকি নিতেই হয় আর সেই ঝুঁকিটা হলো তার নিজের জীবনের ঝুঁকি, ঠিক তেমনি একজন করোনা রোগীর চিকিৎসা করতে গিয়ে একজন ডাক্তার তার জীবনের সবচেয়ে প্রিয় জিনিসটার ওপর ঝুঁকি নেয়, আর সেই ঝুঁকিটা হলো তার নিজের জীবন হারানোর ঝুঁকি। নিকটে ফাঁদ জেনেও কোভিড হাসপাতালে নিয়মিত ডিউটি করেছে ডাক্তার সিস্টাররা, মৃত্যুর চোখ রাঙানিকে তারা ধার ধারেনি, পরোয়া করেনি একরত্তি। জীবনের সাথে করোনার কোনো সম্পর্ক নেই, যতোটা আছে মৃত্যুর সাথে। চিকিৎসাবিজ্ঞানের বহমান যাবতীয় ধারণাকে একেবারে দুমড়ে-মুচড়ে পাউডার বানিয়ে ছেড়েছে করোনা কাহিনি। পৃথিবীতে এমন কোনো পেশার মানুষ নেই যাকে করোনা তার নিজের জগৎকে অপরিবর্তিত রাখতে দিয়েছে। এই ভাইরাস মানুষকে প্রতিদিন বুঝিয়ে দিচ্ছে সভ্যতা এগোচ্ছে, এটা একটা অসার বুলি, মানুষের আদিম অসহায়ত্ব এখনো ঘোচেনি। হাসপাতালে বেড সংকটের জন্যে কোভিড অতিমারিকালে যত রোগী এ হাসপাতাল আর ও হাসপাতালে ঘোরাঘুরি করার সময় রাস্তায় অ্যাম্বুলেন্স কিংবা সিএনজি গাড়িতে বিনা চিকিৎসায় মারা গেছে, এমনটা কখনো ঘটেনি বাংলাদেশে। মানুষ শুধু একটা বেডের জন্যে হন্যে হয়ে ছুটে বেড়াচ্ছে এক হাসপাতাল থেকে আরেক হাসপাতালে ।
জাগতিক বিপর্যাস কিংবা প্রাকৃতপ্রলয় যা-ই ঘটুক না কেন, মানুষের জীবন কিন্তু থেমে থাকে না, যেমন থেমে থাকেনি অভিজিৎ আর স্বপ্নার জীবন। একটি না গাঁথা মালা কিংবা অগ্রন্থিত ভালোবাসা একজন দয়িত কিংবা দয়িতার সাইকো-সেক্সুয়াল জীবনে সুদূরপ্রসারী কতোটা আত্যয়িক প্রভাব বিস্তার করতে পারে, ফ্রয়েডীয় তত্ত্ব আর হ্যাভলক এলিসের মতবাদের আলোকে সেই মনোবিকলন আর মনোবিশ্লেষণের বিষয়-আশয় উঠে এসেছে এই রচনায় ডা. অভিজিৎ আর ডা. স্বপ্না নামের দুজন ডাক্তারের ভালোবাসা-ভালোলাগার কাহিনিকে উপজীব্য করে। করোনা দুষ্কালের ব্যতিব্যস্ত আর বিপ্রকৃত পৃথিবীর স্বরূপ, আধুনিক বিজ্ঞানের সাধ্যের পরিমিততা, নর-নারীর রোমান্সের তোলপাড় করা আকুলতা আর উদাত্ত ভাবোচ্ছ্বাস, বিয়োগান্ত নাটকীয় দৃশ্যের অনিবার্য উন্মীলনগুলোর সাথে করোনাদগ্ধ সময়ের অনন্যগতিক টলটলায়মান পৃথিবীর বাস্তব রূপ, মানুষের অসহায়ত্ব আর অসারত্ব, অগতিক মানুষের আর্তি, করোনা থেকে বেঁচে যাওয়া রোগীদের স্নায়ুতন্ত্রের ওপর কোভিডের দীর্ঘমেয়াদি পার্শ্বক্রিয়াসহ একটি ক্ষুদ্র ভাইরাসের ভুবনবিস্তারী সর্বনাশা বিনাশলীলার আদ্যন্ত—সবকিছু নির্বাক চিত্রের মতো ভেসে উঠেছে এই উপন্যাসের পাতায় পাতায়। সব মিলিয়ে বরেন চক্রবর্তীর লেখা ‘করোনাক্রান্তি’ অন্তরাবর্তন সময়ের অনুভূতি জারিত এক অলোকসামান্য মৌল উপন্যাস।
(এটি লেখকের করোনা ট্রিলজি গ্রন্থমালার তৃতীয় উপন্যাস। প্রথম পর্ব প্রকাশিত হয় ২০২২ সালের ফেব্রুয়ারি মাসে ‘অনিন্দিতার করোনা যুদ্ধ' শিরোনামে এবং দ্বিতীয় পর্ব প্রকাশিত হয় ২০২৩ সালের ফেব্রুয়ারি মাসে ‘করোনাকালে প্রেম' শিরোনামে।)