ক্লাস নাইনের জেনেলিয়া মিছিল থেকে হারিয়ে গেছে। বিষণ্ন শ্যামলদা আর বৌদিকে যাত্রাবাড়ীর অলি-গলির মসজিদগুলোতে মাইকিং করার পরামর্শ দিয়ে আমি আমার নিজের কাজে লেগে গেছি। পরের দিন, যখন আমি বিদ্যুৎ অফিস থেকে ফিরছিলাম, গলি থেকে বের হয়ে দেখি, মহাসড়কের একটা অংশ একেবারেই ফাঁকা-শুনশান-হয়ে আছে। এখানে-সেখানে ছেড়া সেন্ডেল, লাঠিসোটা, ব্যানার, জাতীয় পতাকা এসব পড়ে আছে। আকাশ পরিষ্কার। বাতাস ঘোলাটে। শুধু কেবল, কিছুটা দূরে, কেউ-একজন সামান্য নড়াচড়া করছে। ... এই একটু আগেই কদমতলী, মাতুয়াইল ও সাইনবোর্ডের আকাশ জুড়ে ত্রাস চালিয়েছে সরকারি হেলিকপ্টারগুলো। শকুনের ঝাঁকের মতো মিছিলের চারদিক ঘুরে ঘুরে মুহর্মুহু গুলিবর্ষণ করেছে তারা। সাথে গ্যাস ও গরম পানি। যতটা সম্ভব আহতদের টেনে হিঁচড়ে তাদের রণক্ষেত্রের ভাইয়েরা নিরাপদে নিয়ে গেছে। পথচারী ও আন্দোলনকারী সবাই জীবন নিয়ে পালিয়েছে। য পালায়তি, স জীবতী। ১০ মিনিটের ব্যবধানে জনশূন্য হয়ে পড়েছে পুরো এলাকাটি। আমি অবচেতন মনে এগুতে এগুতে শেষে আটকে গেছি। এখানে, ডিভাইডারের উত্তর পাশে এখন শুধু আমরা দুজন। সে আর আমি! জানি না, কার কাছে সাহায্য চাইব?
ছেলেটির কণ্ঠনালির পাশ দিয়ে গুলি চলে গেছে। সে ‘পানি’! ‘পানি’! বলে মাঝে মাঝে চোয়াল নাড়াচ্ছে। পাখির বাসায় যেভাবে বাচ্চারা-উপরের দিকে মুখ নেড়ে নেড়ে, অস্পষ্ট চিৎকারে-একতরফা ইচ্ছা প্রকাশ করে, ঠিক সেভাবে, বিদগ্ধ চোখে-ফিস ফিস শব্দে- যে কাউকে ডাকছে সে। যখনই কথা বলার চেষ্টা করেছে, তখনই গল গল করে রক্ত বের হচ্ছে, চোয়ালের নিচ থেকে। সেখানেই গুলি লেগেছে। তার ঠোঁটের কাছে আঙুল নিয়ে আমি শুধু বললাম-‘শু স স’-কথা বলতে হবে না!
দূরে, প্রত্যন্ত গ্রামে পাঁচ বছরের টুনি তার জন্য অপেক্ষা করছে। আর অপেক্ষা করছে টুনির মা ও টুনির নানি। তারা সবাই ভাবছে এ সরকারের পতন হবে, আর তাদের প্রিয় মানুষগুলো যে যার যার ঘরে ফিরে আসবে। টুনির মামা ইমন এখন অন্ধ। পুলিশ সামনে থেকে তার চোখ বরাবর তাক করে গুলি করেছে তাকে, বনানিতে তার ক্যাম্পাসের একটু দূরে, বড় সড়কের-ডিভাইডারের পূর্ব পাশে। সে ঢাবির বন্ধুদেরকে নিজের মেসে আশ্রয় দিয়েছে। জসীমউদ্দীন হল-এর বন্ধু রুমনকে পুলিশ ধরে ফেলেছিল। তাকে ছাড়িয়ে আনতে যেয়ে গুলি খেয়েছে ইমন। ইমনসহ আরো অনেক ছাত্র গুলিবিদ্ধ হয়েছে, শত শত নিহত হয়েছে, সহস্র সহস্র আহত হয়েছে, কলেজের ছেলেরা, স্কুলের ছেলেরা এমনকি তাদের বাবা-মায়েরা রাস্তায় বের হয়েছে। পরিস্থিতির প্রেরণা সম্পূর্ণ জাতিকে জাগিয়ে তুলেছে ধীরে ধীরে। পরিস্থিতির স্বতঃ প্রেরণা ও পরতঃ প্রেরণার এক দারুণ সমন্বয়ে এ আলোড়ন নির্মিত হয়েছে, যার অবয়বে আছে বিপ্লবের উদ্যমতা আর নির্যাসে,... গণজাগরি জাতীয়-সহমর্মিতা।
সবকিছু থেমে গেলে কিছু অপেক্ষার নিষ্পত্তি হয়। যাদের ঘরে ফেরার কথা ছিল তারা সবাই ফেরে না। অতৃপ্ত হৃদয়গুলো আবার নতুনভাবে নতুন করে স্বপ্ন দেখা শুরু করে। ত্রিভুজ প্রেমে জড়িয়ে থাকা তিনটি হৃদয় নিজেদের ভালোবাসাকে নতুন করে সংজ্ঞায়িত করে। জীবন চলতেই থাকে।