সালাম ও সালাত ইসলামের মূর্ত প্রতীক ও একত্ববাদের স্বতঃপ্রকাশিত সারদাতা দূরে এলাহী মুহাম্মাদ (সা)-এর প্রতি, যিনি সুন্নাতে রারে জুলজালালের পরিপূর্ণ প্রকাশ এবং যিনি স্রষ্টার সম্মুখে ইবাদত করার স্বরূপ ও পদ্ধতিকে সুস্পষ্টভাবে দেখিয়ে গেছেন। আর ইসলাম ও কুরআনের নামে দ্বীনে মুহাম্মাদী (সা)-কে ধ্বংস করার যে নোংরা ও শিরকী চক্রান্ত তার বিরুদ্ধে যাঁরা সংগ্রাম করেছেন এবং সত্যিকারের একত্ববাদ ও সীরাতুন্নবী (সা)-কে তুলে ধরেছেন সেই পুত পবিত্র আহলে বাইতে নবুওয়ার (আ)-এর প্রতি সালাম অতঃপর দরুদ ও সালাম বর্ষিত হোক হোসাইনের উপর সিনি কারবালায় সত্য থেকে মিথ্যাকে চুড়ান্ত ভাবে পৃথক করেছেন। আর সত্য থেকে মিথ্যাকে পৃথক করতে গিয়ে তাঁকে জীবন উৎসর্গ করতে হয়েছে। কিন্তু প্রশ্ন হলো কেন তিনি তাঁর জীবন উৎসর্গ করেছেন। ধীমানদের নিকট থেকে উত্তর আসবে ‘তাঁর ইমামত’। তাহলে ইমামত কি? ইমামত বলতে বোঝায় আধ্যাত্মিক নেতৃত্ব এবং জনগণের সাথে মানসিক ও ধর্মীয় সংযোগ। কিন্তু রাজতন্ত্র ও একনায়কতন্ত্রে শাসনকার্য পরিচালনার জন্য বল, ক্ষমাতা এবং প্রতারণার আশ্রয় নেওয়া হয়। এমনকি গণতন্ত্রেও, যদিও তাতে জনগণের অধিকারের কথা বলা হয়ে থাকে, সেখানেও কোন কোন ক্ষেত্রে এগুলোকে ব্যবহার করা হয়। এই রাজতন্ত্রের ধারায় স্বৈরশাসক ও ধর্মদ্রোহী ইয়াজিদের সময় মানবতা নিপীড়ন, অজ্ঞাতা এবং বৈষম্যের শিকার হয়েছিল। অবশ্য শুধু ইয়াজিদ নয় বিশ্বের সকল স্বৈরাচারী
শাসকগণ তাদের ভাষায় অভিজাত কিন্তু জনগণ নয়। তারা বিবেকহীন ও দুর্নীতিতে পূর্ণ এবং অস্ত্রের জোরে শাসনকার্য পরিচালনা করে। সেই সময় যদিও, ইসলামের আলো জাজিরাতুল আরবকে আলোকিত করেছিল এবং আল্লাহর সাহায্যে তা সমগ্র বিশ্বে ছড়িয়ে পড়ে। কিন্তু কিছু দিন পরেই শুধু ইসলামের নাম রয়ে যায়, আর ন্যায়বিচারের পরিবর্তে নিপীড়নের শাসন প্রতিষ্ঠিত হয়। এ যেন ইসলামের আলখেল্লায় ধর্মদ্রোহীদের রাজত্ব। সাম্য, ভ্রাতৃত্ব, জ্ঞান ও একে-অপরের প্রতি সম্মান প্রদর্শনের পরিবর্তে বৈষম্য, শত্রুতা ও অজ্ঞতা প্রতিষ্ঠিত হয়। সেই সময়ের শাসনকর্তা ছিল ইয়াজিদ, সে ছিল ধার্মিক জনগণ থেকে বিচ্ছিন্ন এবং জ্ঞান, সততা ও ধার্মিকতা বর্জিত এক দুর্নীতিপরায়ণ শাসক। ইসলামী ধর্মাচারণের প্রতি তার কোন শ্রদ্ধাবোধ ছিল না এবং তার আচরণে ইমানের কোন লক্ষণও পরিলক্ষিত হতো না। এই পরিস্থিতিতে স্বর্ণীয় অনুজ্ঞার ধারক ও বাহক ইমাম হোসাইন (আ) তার বিরুদ্ধে উঠে দাঁড়ান। যদি সেই সময়ের পরিস্থিতি বিশ্লেষণ করা যায়, তাহলে দেখা যাবে যে ইমাম হোসাইন (আ)-এর এই বিপ্লব ছিল ইয়াজিদের দুর্নীতিগ্রস্ত সরকারের বিরুদ্ধে একটি বিদ্রোহ। যা ছিল আসলে ইসলামী মূল্যবোধ, জ্ঞান, বিশ্বাস এবং সম্মান পুনরুদ্ধার করার জন্য একটি বিপ্লব। এটি ছিল দুর্নীতি, অপমান এবং অজ্ঞতা থেকে মানুষকে বিশেষভাবে ইসলামী সমাজকে রক্ষা করার জন্য একটি বিপ্লব।
‘ইমামত’ হলো একটি খোদায়ী শাসন ব্যবস্থা, যার দ্বারা রাজতন্ত্র, গোত্রতন্ত্র, বর্ণবাদ ও স্বৈরাচারী সমাজ কাঠামো ভাঙা হয়েছিল, যেগুলো প্রতিষ্ঠিত হয়েছিল গোত্র প্রধানদের বল, ক্ষমতা এবং প্রতারণা ব্যবহার করে।
ইমাম হোসাইন (আ) যিনি কোরআনের আধ্যাত্মিক ও বিপ্লবী ব্যাখার মূর্ত প্রতীক, যিনি নাজাতের তরী ও হেদায়েতের জ্যোতি, যিনি কারবালার মুহাম্মাদ (আ), সেই হোসাইন (আ) বলেছিলেন: “যদি মুহাম্মাদ (সা)-এর দ্বীন আমার কতল ছাড়া টিকে না থাকে তাহলে এসো হে তরবারী। নাও আমাকে গ্রহণ কর।” নিশ্চয়ই কারবালার ঘটনা এমন এক মর্মবিদারী বিষয় যা মানব ইতিহাসের দীর্ঘপরিক্রমায় সংঘটিত হওয়া অজস্র ঘটনার মাঝে সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ ও শিক্ষণীয়। নিঃসন্দেহে ইমাম হোসাইন (আ)-এর এই মহান ও একমেবাদ্বিতীয়ম আত্মত্যাগ এমন এক বিস্ময়কর ঘটনা যার সামনে বিশ্বের চিন্তাবিদগণ তাঁদের কপালে ভাঁজ ফেলতে বাধ্য হন। ইমাম হোসাইন (আ) সেই মহামানব যার কাছে শুধু ইব্রাহিম (আ) ও ইসমাঈলই (আ) ঋণী নয় বরং সকল আম্বিয়া, মুরসালিন ঋণী, কারণ “হোসাইন আমা থেকে আর আমি হোসাইন থেকে।” রাসুলুল্লাহ (সা)-এর এই বাণীর মধ্যে নিহিত রয়েছে কারবালার বিপ্লবের রহস্য।
‘অপমান আমাদের সয়না’-এই উক্তির আলোকে তিনি সত্য ও ন্যায় প্রতিষ্ঠায় গুটিকয়েক সাথীদের নিয়ে ময়দানে উপস্থিত হন এবং খোদীয় প্রেমের সুধা পান করে ‘জিবহে আযিম’-এ পরিণত হন। ইসলাম ও মানবতার জন্য তাঁর এই নজিরবিহীন আত্মত্যাগে মুসলিম ও অমুসলিম পন্ডিতগণ পরম বিস্ময়ে অভিভূত হয়ে তাঁর স্তুতি-বন্দনায় মুখরিত হয়েছেন এবং তাঁর এই আত্মত্যাগ স্বমহিমায় মহিমান্বিত।
কিন্তু প্রশ্ন হলো ইমাম হোসাইন (আ)-এর হত্যাকারী কে? এর উত্তরে সকল বিবেকবান ও ন্যায়পরায়ণ ব্যক্তি একমত যে ইমাম হোসাইন (আ)-এর হত্যাকারী হলো ইয়াজিদ বিন মুয়াবিয়া (লা) কিন্তু একশ্রেণীর তথাকথিত মুসলিম, সহীহ আকিদার অনুসারী নামে পরিচয়দানকারী নাসেবী কুলাঙ্গাররা তা স্বীকার করে না, উল্টো তারা শী’য়ানে আলীকে ইমাম হোসাইন (আ)-এর হত্যাকারী বলে নেট দুনিয়া থেকে শুরু করে তাদের সকল ওয়াজ-বয়ানে ও লিখনের মাধ্যমে মিথ্যা প্রচার করে চলেছে। তাই সম্মানিত পাঠক, আমি সুন্নি ও সালাফিদের সহীহ ও বিশ্বস্ত ইতিহাস, সীরাত ও রেওয়ায়েতের কিতাবসমূহ থেকে সেই প্রকৃত ঘটনা ও সত্যকে তুলে ধরার চেষ্টা করেছি যাতে প্রমাণিত হয়েছে যে, ইমাম হোসাইন (আ)-এর হত্যাকারী হলো ইয়াজিদ বিন মুয়াবিয়া ও তার সমর্থকগণ। এক কথায় বলতে পারি ইমাম হোসাইন (আ)-এর হত্যার নেপথ্যে অভিশপ্ত ইয়াজিদই ছিল প্রধান আসামী।
নাসেবীদের বক্তব্যগুলো বিভিন্ন ওয়েব সাইট, গ্রন্থ ও প্রবন্ধ (যেমন- Ansar org. hcy.com, chiite fr. A Shia Killed Sayyiduna Hussain by Ibn Al Hasimi) থেকে উদ্ধৃত করা হয়েছে।
পরিশেষে পরম করুনাময় দয়ালু আল্লাহর কাছে বিনীতভাবে প্রার্থনা জানাই তিনি যেন আমাদেরকে সাইয়্যেদুশ শোহাদা ইমাম হোসাইন (আ)-এর জিয়ারাত ও শাফায়াত নসীব করেন এবং হযরত মুহাম্মাদ (সা) ও আলে মুহাম্মাদ (সা)-এর পবিত্র জীবনাদর্শ অনুসরণের মাধ্যমে জীবন যাপন করার সৌভাগ্য দান করেন। আমিন, যে হাক্কে মুহাম্মাদ (সা) ওয়া আলে মুহাম্মাদ (সা)।
হে সাহেব আল আমর (আ.ফ.শ.), আপনার উপর আল্লাহর রহমত বর্ষিত হোক আমি আপনার সদয় দৃষ্টি কামনা করছি, আর হে আল্লাহর রাসুল (সা)-এর সন্তান অনুগ্রহ করে আমাকে কখনোই পরিত্যাগ করবেন না।
আল্লাহুমা সল্লে আ’লা মুহাম্মাদ ওয়া আলে মুহাম্মাদ ওয়া আজ্জিল ফারাজাহুম। সকল প্রশংসা একমাত্র আল্লাহর।
মোঃ তুরাব রসুল
রাজশাহী, বাংলাদেশ
তারিখ: ১৪ই নভেম্বর ২০২৪
ভূমিকা
শী’য়ারা ইমাম হোসাইন (আ)-কে হত্যা করেছে প্রচলিত এই মিথ্যাটিকে নাসেবী লেখকরা চিরস্থায়ীত্ব দান করেছে, তা খণ্ডনে আমরা ইতিহাসের তথ্য বিশ্লেষণ করব যাতে এই ধরনের দাবির ভ্রান্তি ফুটে ওঠে। তাদের সংক্ষিপ্ত যুক্তিগুলো নিম্নরূপ:
১. শী’য়ারা ইমাম হোসাইন (আ)-কে চিঠি লিখে কুফায় আসার জন্য আমন্ত্রণ জানায় যাতে তারা তাঁকে তাদের ইমাম হিসেবে গ্রহণ করতে পারে।
২. ইমাম হোসাইন (আ) পরিস্থিতি মূল্যায়নের জন্য মুসলিম বিন আকিল (আ)-কে তাঁর প্রতিনিধি হিসেবে পাঠান।
৩. শী’য়ারা হযরত মুসলিম বিন আকীল (আ)-এর মাধ্যমে ইমাম হোসাইন (আ)-এর বায়আত (আনুগত্যের অঙ্গীকার) গ্রহণ করে।
৪. আবদুল্লাহ ইবনে যিয়াদের কুফায় প্রবেশের পর একই শী’য়ারা পরবর্তীতে তাঁকে পরিত্যাগ করে।
৫. শী’য়ারা ইমাম হোসাইন (আ)-কে সহায়তা করতে ব্যর্থ হয় যার ফলে তাঁকে হত্যা করা হয়।
এখানে যে পদ্ধতি গ্রহণ করেছি তাহলো বিস্তারিতভাবে ঐতিহাসিক উৎসের উপর আলোকপাত করা এবং তারপরে কুফাবাসীদের বিশ্বাসকে চিহ্নিত করে তা প্রকাশ করা।
সূচীপত্র
প্রথম অধ্যায়: হোসাইন ঐশী পথপ্রদর্শকদের উত্তরাধিকারী
দ্বিতীয় অধ্যায়: রাজনৈতিক শী’য়া যারা শায়খাইনের খেলাফতে বিশ্বাসী বনাম ধর্মীয়-ইমামী শী’য়া
তৃতীয় অধ্যায়: কুফাবাসীদের প্রকৃত আকীদা
চতুর্থ অধ্যায়: ইয়াজিদের পক্ষে বাইয়াতের (আনুগত্যের অঙ্গীকার) সূচনা
পঞ্চম অধ্যায়: শায়খাইনের খেলাফতে বিশ্বাসী শী’য়াদের পক্ষ থেকে ইমাম হোসাইন (আ)-এর প্রতি চিঠি
ষষ্ঠ অধ্যায়: সাহাবী সুলাইমান ইবন সারদ (রা) ও তাওয়াবুনের প্রতি নাসেবীদের আপত্তি
সপ্তম অধ্যায়: মুসলিম বিন আকিল (আ)-কে হত্যায় সাহাবা ও তাদের পুত্রদের অংশগ্রহণ
অষ্টম অধ্যায়: উসমানের শী’য়ারা (নাসেবী) ইমাম হোসাইন (আ)-কে হত্যা করেছিল
পরিশিষ্ট-২ : ইমাম হোসাইন (আ)-এর প্রশংসা ও শোক প্রকাশ সংক্রান্ত ৪০টি হাদিস
পরিশিষ্ট-৩ : ইমাম হোসাইন (আ)-এর অভ্যুত্থান (বিপ্লব) সম্পর্কে আয়াতুল্লাহ সাইয়্যিদ আলী খামেনেয়ীর দশটি শিক্ষনীয় বক্তব্য
পরিশিষ্ট-৪ : সাধক ও কবির ভাষায় ইমাম হোসাইন (আ)
পরিশিষ্ট-৫ : ইমাম হোসাইন (আ)-এর প্রতি লেখকের প্রশংসাত্মক কথন
পরিশিষ্ট-৬ : বিশ্বের বুদ্ধিজীবী ও চিন্তাবিদ কর্তৃক ইমাম হোসাইন (আ)-কে মূল্যায়ন
পরিশিষ্ট-৭ : হযরত মুহাম্মাদ মোস্তফা (সা)-এর দৌহিত্র হাসনাইন (আ) ও তাঁর প্রতিচ্ছবি আলী আকবর (আ)-এর প্রতি লেখকের হৃদয়ের অন্তস্থল থেকে ভক্তিমূলক সালাম পেশ