বাংলা সাহিত্যে সীরাতচর্চার ইতিহাসে কবি গোলাম মোস্তফার ‘বিশ্বনবী’ একটি মাইলফলক গ্রন্থ। নবীজী ﷺ এর জীবন আদর্শ সহজ ও প্রাঞ্জল ভাষায়, কাব্যধর্মী গদ্যের অনন্য গাঁথুনিতে এ গ্রন্থে প্রকাশ পেয়েছে । কবি গোলাম মোস্তফা ‘বিশ্বনবী’ গ্রন্থে নবীজীর জন্ম থেকে শুরু করে সামগ্রিক জীবন তথা দাওয়াত, সংগ্রাম, হিজরত, মদীনায় রাষ্ট্রগঠন, জিহাদ, শান্তি-নীতি, বিদেশনীতি, পরিবার, সমাজ, বিদায় হজ্জ ও ইন্তেকাল — সবকিছু ধারাবাহিকভাবে তুলে ধরোছেন। পাশাপাশি সংযুক্ত দ্বিতীয় খণ্ডে নানাবিধ সংশয়ের তথ্য ও যুক্তিনির্ভর জবাব দিয়েছেন জোরালো ভাবে।
গ্রন্থটির বৈশিষ্ট্য হলো — ঐতিহাসিক সত্যকে সাহিত্যের আবেগ ও আধ্যাত্মিকতার অনুরাগে পাঠকের হৃদয়ে নবীপ্রেম জাগাতে সক্ষম হয়েছে। বিশ্বনবী শুধু নবী মুহাম্মদ ﷺ এর জীবনী নয়, বরং এটি বাংলা সাহিত্যের অমূল্য সম্পদ। তাইতো আমরা দেখি বিশ্বনবী পাঠে মুগ্ধতা জানিয়েছেন আলেমওয়ালামা পীরমাশায়েখ মুসলিম অমুসলিম বিদগ্ধ বহু বিদ্বান মানুষজন।
‘বিশ্বনবী’ প্রকাশের ৮ দশক পেরিয়ে গেছে। শতাধিক মুদ্রণে লাখ লাখ কপি মানুষের ঘরে ঘরে পৌঁছে গেছে। তবু এর অনন্যতা একটুও যেন কমেনি। বরং প্রজন্ম থেকে প্রজন্মে ছড়িয়ে পড়েছে গোলাম মোস্তফার বিস্ময়কর নবী প্রেমের সৃজনশোভা।
তালবিয়া প্রকাশন তার 'চিরায়ত সীরাত' প্রকল্পের ধারাবাহিকতায় প্রকাশ করছে গোলাম মোস্তফা রচিত ‘বিশ্বনবী’। আমরা চেষ্টা করেছি সবকিছুই আগের মত রাখতে। শুধুমাত্র আয়াত ও হাদীসের নম্বর জনিত ক্রুটিগুলো সংশোধন করা হয়েছে যা জরুরী ছিলো। আমরা আশাকরি সম্মানিত পাঠক সমাজ আমাদের নব উদ্যোগে ঋদ্ধ হবেন।
কবি গোলাম মোস্তফার বিস্ময়কর সৃষ্টি বিশ্বনবী! সীরাতগ্রন্থটি সম্পর্কে কয়েকজন গুণীজনেরঅভিমত উল্লেখ করা হলো...
গোলাম মোস্তফার জন্ম ১৮৯৭ সালে যশোর জেলার ঝিনাইদহ মহকুমার শৈলকূপা থানার অন্তর্গত মনোহরপুর গ্রামে। পিতা কাজী গোলাম রব্বানী, পিতামহ কাজী গোলাম সরওয়ার। তাঁরা ছিলেন সাহিত্যানুরাগী-ফারসী ও আরবী ভাষায় সুপন্ডিত। তাঁর তিন পুত্রের মাঝে একজন হলেন বিখ্যাত পাপেটনির্মাতা ও চিত্রশিল্পী মুস্তফা মনোয়ার এবং সাম্প্রতিককালের অস্কারজয়ী বাংলাদেশী নাফিস বিন জাফর তাঁর নাতি।
শিক্ষা জীবন গোলাম মোস্তফার শিক্ষা জীবনের সূচনা হয় চার বছর বয়সে নিজগৃহে ও পার্শ্ববর্তী দামুকদিয়া গ্রামের পাঠশালায়। কিছুদিন পরে তিনি ফাজিলপুর গ্রামের পাঠশালাতে ভর্তি হন। দু’বছর এই পাঠশালায় বিদ্যা অর্জনের পরে তিনি ভর্তি হলেন শৈলকূপা উচ্চ ইংরেজী স্কুলে। ১৯১৪ সালে এই স্কুল থেকে বিশেষ কৃতিত্বের সাথে তিনি প্রবেশিকা বা ম্যাট্রিকুলেশন পাশ করেন। ১৯১৬ সালে তিনি দৌলতপুর বি. এল কলেজ থেকে আই. এ এবং ১৯১৮ সালে কলকাতা রিপন কলেজ থেকে বি. এ পাশ করেন। পরে ডেভিড হেয়ার ট্রেনিং কলেজ থেকে বি. টি ডিগ্রীও লাভ করেন।
পেশাগত জীবন ১৯২০ সালে জানুয়ারী মাসে ব্যারাকপুর সরকারি হাই স্কুলের সহকারী শিক্ষক হিসেবে গোলাম মোস্তফার শিক্ষকতা জীবনের সূচনা হয়। ১৯২৪ সালে ব্যারাকপুর হাই স্কুল থেকে তিনি কলকাতা হেয়ার স্কুলে বদলী হন। দীর্ঘদিন এখানে শিক্ষকতা করার পর তিনি কলকাতা মাদ্রাসায় বদলী হন। সেখান থেকে ১৯৩৫ সালে বালিগঞ্জ সরকারি ডিমনেষ্ট্রেশন হাই স্কুলে বদলী হয়ে সহকারী প্রধান শিক্ষকের পদে উন্নীত হন এবং কয়েক বছর পর উক্ত বিদ্যালয়ে প্রধান শিক্ষকের পদমর্যাদা লাভ করেন। এই বিদ্যালয়ের তিনিই প্রথম মুসলিম প্রধান শিক্ষক। ১৯৪০ সালে তিনি বাঁকুড়া জিলা স্কুলে বদলী হন। শিক্ষকতা জীবনে বিভিন্ন স্কুলে শিক্ষকতা করার পর ১৯৪৬ সালে তিনি ফরিদপুর জিলা স্কুলের প্রধান শিক্ষকের দায়িত্বভার গ্রহণ করেন। দীর্ঘ ত্রিশ বছর শিক্ষকতা করার পর ১৯৫০ সালে তিনি চাকরি থেকে অবসর গ্রহণ করেন। বাংলা সাহিত্যের সাধক কবি গোলাম মোস্তফা তাঁর শেষ জীবনের কয়েক বছর ঢাকা শান্তিনগরস্থ নিজ গৃহে (মোস্তফা মঞ্জিল) অতিবাহিত করেন। বেশ কিছু দিন রোগ যন্ত্রণা ভোগ করার পর কবি ১৯৬৪ সালের ১৩ অক্টোবর ঢাকা মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে শেষ নিঃশ্বাস ত্যাগ করেন।