অনেক দিন ধরেই আমার মনে একটি ইচ্ছা সুপ্ত ছিল যে, ‘ভারতবর্ষের সঙ্গে আরবের সম্পর্ক’ বিষয়ে দেশবাসীর সামনে ইতিহাসের একটি পূর্ণাঙ্গ বয়ান উপস্থাপন করব, কোনো বক্তৃতা বা প্রবন্ধের মাধ্যমে। ভারতবর্ষের সঙ্গে আরবের প্রাচীন যোগসূত্র তো প্রমাণসিদ্ধ সত্য; তবে শুধু এর একাডেমিক বয়ানই নয়, আমার মনে হয় ভারতবর্ষের হিন্দু-মুসলিম দুই জাতির আদি ইতিহাস ও সোনালি অতীত এই সময়ে সামনে আনা বিশেষ প্রয়োজন। আবহমানকাল থেকেই তো ভারতবর্ষের জাতিগোষ্ঠী পাশাপাশি দুটো শাখায় বহমান—হিন্দু ও মুসলমান। এই ভূমির দুটো স্রোতধারাই অভিন্ন মোহনায় একীভূত।
আমরা মনে করি, ভারতবর্ষের বর্তমান বিভেদময় পরিস্থিতিতে বড় দায় ও দায়িত্ব আমাদের স্কুল-কলেজের ইতিহাস পাঠ্যক্রমের ওপর বর্তায়। আর এ কারণে আমাদের ইতিহাসবিদদের দায়িত্বও অনেক গুরুত্বপূর্ণ হয়ে উঠেছে।
আমি কৃতজ্ঞতা প্রকাশ করছি ‘হিন্দুস্তানি একাডেমি’, এলাহাবাদ (বর্তমানপ্রয়াগরাজ, উত্তরপ্রদেশ)-এর প্রতি, তারা আমার দীর্ঘদিনের লালিত ইচ্ছেটা বাস্তবায়নের সুযোগ করে দিয়েছেন। আমি আশা করি, যে আন্তরিকতার সঙ্গে আমি ইতিহাসের প্রাচীন আকরগ্রন্থসমূহে ছড়িয়ে-ছিটিয়ে থাকা তথ্য-উপাত্ত সংগ্রহ করেছি এবং হাজার হাজার পৃষ্ঠা অধ্যায়ন করে এই অল্প কয়েক পৃষ্ঠায় সংকলন করেছি, আপনারা সেই আন্তরিকতার মর্যাদা রেখেই আজ শুনবেন এবং আগামীদিনে পাঠ করবেন।
একাডেমি আমাকে তিনটি বক্তৃতার অনুরোধ জানিয়েছিল। কিন্তু ইতিহাসের পূর্ণাঙ্গ বয়ান তুলে আনতে এবং বিষয়বস্তুর প্রতিটি দিক স্পর্শ করতে আমি পাঁচটি বক্তৃতা প্রস্তুত করেছি, যাতে আলোচনা কোনো দিক থেকে অসম্পূর্ণ না থাকে।
এখানে বর্ণিত সকল ঘটনা ও তথ্য-উপাত্ত আমি সংগ্রহ করেছি আরবী ভাষার নির্ভরযোগ্য ও প্রামাণ্য উৎসগ্রন্থ থেকে। প্রয়োজনে ইংরেজি ও ফারসি ভাষার গ্রন্থাদি থেকেও সাহায্য নিয়েছি।
ভারত-উপমহাদেশে সিরাতচর্চা, ইতিহাস ও আরবিভাষার সাহিত্য নিয়ে যারা গবেষণামূলক কাজ করেছেন, কর্মগুণে হয়েছেন বিশ্ববরেণ্য—সাইয়েদ সুলাইমান নদবি রহ. তাদের সবচেয়ে অগ্রসারির। ১৮৮৪ সালে ব্রিটিশ-ভারতের বিহারের দিসনাতে জন্মগ্রহণ করেন তিনি। বিশ্ববিখ্যাত নদওয়াতে পড়াশোনা করে সেখানেই দীর্ঘ দিন আরবিভাষার পাঠদান করেন এই প্রাজ্ঞ প্রতিভাধর; পাশাপাশি ছিলেন আন-নদওয়া আরবি পত্রিকার সহযোগী সম্পাদক। কর্মজীবনে শিক্ষকতা ও সম্পাদনার পাশাপাশি লিখেছেন অসংখ্য কালজয়ী গ্রন্থ, প্রদান করেছেন পৃথিবীখ্যাত সিরাত-বিষয়ক ভাষণ—খুতুবাতে মাদরাজ নামে যা বিশ্ববিখ্যাত। সিরাতুন নবি (যুগ্ম), সিরাতে আয়েশা, আরদুল কুরআন, খৈয়ামসহ যা-ই তিনি লিখেছেন, সেটিকেই করে তুলেছেন পাঠ-অনিবার্য। এসব আকরগ্রন্থ তাকে এনে দিয়েছে অমরত্বের মর্যাদা। তার লেখা ইতিহাসের পাণ্ডুলিপিগুলো শাস্ত্রীয় সংজ্ঞা পার হয়ে হৃদয়কেও স্পর্শ করে প্রবলভাবে।