লেখকের কথা
"নীরবতার শহরে কান্নার অবরোধ" আমার কাছে এটি কেবল একটি বই নয়, এটি এক নীরব যাত্রা।
একটি শহরের ভিড়ের আড়ালে জমে থাকা অদৃশ্য অশ্রুর ইতিহাস। আমরা প্রতিদিন হেঁটে যাই পথে-ঘাটে, দেখি মানুষের মুখে হাসি, ঠোঁটে ব্যস্ততার শব্দ, কিন্তু সেই হাসির আড়ালে, সেই শব্দের গহীনে লুকিয়ে থাকে অগণিত নিঃশব্দ দীর্ঘশ্বাস। যা কারো চোখে পড়ে না, কারো কানে শোনা যায় না।
এই বই আসলে সেই নিঃশব্দ কান্নার প্রতিচ্ছবি আঁকার চেষ্টা।
আমরা এমন এক সমাজে বাস করি যেখানে উচ্চকণ্ঠে অনেক কথা বলা হয়,প্রচার হয়, শ্লোগান ওঠে, তর্ক চলে, কিন্তু মানুষ যখন সত্যিই কাঁদে, যখন তার বুকের গভীর ক্ষত চিৎকার করতে চায়,তখন আশেপাশের পৃথিবী থাকে বধির,
তার কণ্ঠ কেউ শোনে না।
মানুষ অনেক সময় নিজেকেও বোঝাতে পারে না,
ফলে অশ্রু জমে থেকে যায় বুকের ভেতরে একটি অবরোধ হয়ে।
আমি চেয়েছি সেই অবরুদ্ধ মানুষদের হয়ে লিখতে।
তাদের না-বলা কথাগুলোকে শব্দে রূপ দিতে। তাদের চাপা দীর্ঘশ্বাসকে কণ্ঠ দিতে।আমার কলম তাই গল্পের শরীর বেছে নিয়েছে, যাতে নিঃশব্দ যন্ত্রণা রক্ত-মাংসের মতো ছুঁয়ে যায় পাঠকের হৃদয়।
এই বইয়ের প্রতিটি গল্প আসলে সমাজের আয়না। এখানে আপনি খুঁজে পাবেন মুখোশে ঢাকা মানুষ, প্রেমে জর্জরিত হৃদয়,অন্যায়ের সাথে নীরব আপস,শেকড় হারানোর বেদনা, আবার পাবেন সংগ্রাম, টিকে থাকা আর নতুন আশার দীপ্তি।
হয়তো কোনো কোনো গল্পে আপনি খুঁজে পাবেন আপনার নিজের প্রতিচ্ছবি,
হয়তো গল্পের কোন লাইনের ভেতর আপনি খুঁজে পাবেন আপনার জীবনের অম্ল-মধুর অধ্যায়। আমি বিশ্বাস করি, একজন লেখকের লেখা তখনই পূর্ণ হয়
যখন তা কেবল পড়া শেষ করে ফেলে দেওয়া যায় না,
বরং তা পাঠকের বুকের ভেতরে নাড়া দিয়ে যায়, তাকে ভাবায়, কাঁদায়, অথবা নতুনভাবে স্বপ্ন দেখায়।
"নীরবতার শহরে কান্নার অবরোধ" নামটি আমি বেছে নিয়েছি এই বিশ্বাস থেকে,যে শহর যতই কোলাহলমুখর হোক না কেন, তার বুকের গভীরে জমে থাকে বিশাল নীরবতা। সেই নীরবতার দেয়ালে জমে থাকে অগণিত মানুষের কান্না, যা কখনো উচ্চারিত হয় না, তবু সময়ের ইতিহাস হয়ে বেঁচে থাকে।
আমার কলম শুধু সেই ইতিহাসকে ছুঁতে চেয়েছে, সেই অশ্রুর ভাষা খুঁজে দিতে চেয়েছে।
আমি জানি, প্রতিটি লেখা হয়তো পাঠকের কাছে আলাদা রকম অনুভূতি জাগাবে। কোনো গল্পে আপনি ভেঙে পড়বেন,
কোনো গল্পে হয়তো শক্ত হয়ে দাঁড়াবেন, আবার কোনো গল্প পড়তে পড়তে চুপচাপ তাকিয়ে থাকবেন দূরে যেন নিজের ভেতরের প্রতিচ্ছবিকে খুঁজছেন। এই বই ঠিক সেই নিরব প্রতিচ্ছবি খুঁজে পাওয়ার জন্যই লেখা।
আমার কাছে এই গ্রন্থ শুধু একটি সাহিত্যকর্ম নয়, এটি এক ধরনের দায়বদ্ধতা।
সমাজের কাছে দায়, মানুষের কাছে দায়, এবং সবচেয়ে বড় কথা নিজের অন্তরের কাছে দায়।
কারণ আমি নিজেই এই নীরব শহরের একজন মানুষ, আমার ভেতরেও আছে অগণিত জমে থাকা দীর্ঘশ্বাস। সেগুলোই রূপ নিয়েছে এই লেখাগুলোতে।
সবশেষে আমি কৃতজ্ঞ সেই সকল মানুষদের প্রতি
যারা আমাকে পথ দেখিয়েছেন, অনুপ্রেরণা দিয়েছেন, এবং সমাজের আয়নায় তাকাতে শিখিয়েছেন।এই বই তাদের জন্য, যারা নীরবে কাঁদে অথচ মুখে কিছু বলে না,
যাদের কান্না শহরের কোলাহলে চাপা পড়ে যায়। আমার বিশ্বাস, একদিন এই নীরবতার প্রাচীর ভেঙে যাবে, আর সেই দিনই সত্যিকারের মুক্তি আসবে মানুষের ভেতরে।
এই বই পাঠকের হাতে পৌঁছাক, হৃদয়ে আশ্রয় পাক এটাই আমার একমাত্র কামনা। যদি একটি লাইনও আপনার মনে আলো জ্বালাতে পারে, যদি একটি চরিত্রও আপনাকে ভাবতে বাধ্য করে,
তাহলে আমার লেখা বৃথা নয়।
আবদুল্লাহ্ ফুয়াদ
কেরানীগঞ্জ, ঢাকা।