সাতরঙা ভারুয়াখালী: বইবাহিক সময়-ভ্রমণ
১.
লাভের আর লোভের জ্যামিতিতে সতত বসত আমাদের। আমাদের আত্মা বন্ধক আছে সিন্দুকভর্তি টঙ্কার ঝঙ্কার ধ্বনির কুহক-আহ্বানে। দৌলত-ডাকিনী সিথানের কাঠি পৈথানে দিয়ে ঘুমঘোরে পাঠিয়েছে আমাদের ললিত বিবেক, ঐতিহ্য-চেতনা আর নন্দন-বোধকে। টাকার নামের শব্দ, বুদ্ধদেব বসুর মতো বলতে হয়, আমাদের কানে আর প্রাণে গানের মত, আমাদের মর্মের মাঝে মর্মরি বাজে, ‘কঙ্কাবতী, ওগো টঙ্কাবতী!’ তাইতো টলেমির Geography দূর কি বাত, সাধারণ ভূগোল, ইতিহাস-ঐতিহ্য-চেতনা এবং এ বিষয়ক প্রকাশনার জগৎ আমাদের কাছে বাড়ির কাছের অজানা আরশিনগর। সে জাদুনগরের বেতের ফলের মতো ম্লানচোখ-কন্যাদের সাথে আমাদের কভু হয় নাকো দেখা। মূলত এখন আমাদের এ সবুজ করুণ ডাঙ্গায় কবি আবু হাসান শাহরিয়ার এর ভাষায়, ‘‘ খুনের আসামী মেলে, শুমারিতে বাউল মেলেনা।’’
২.
যুগ-ঝোঁকের সর্বগ্রাসী জলস্রোতে বানভাসিদের মাঝেও কিছু আলোর পথের যাত্রী দাঁড়িয়ে যান সিনা টান টান করে। প্রচ- ঝড় তুফানের মাঝেও ‘বদর, বদর’ বলে তারা অকূল অর্ণব জয় করে নোঙ্গর প্রত্যাশা করেন। জীবনের সমুদ্র সফেন জয় করা এসব মহৎ প্রাণেরা আসলে তাড়িত হন সরণদ্বীপের সোনালি আহ্বানে। এ আহ্বান সাইরেন-সঙ্গীতের চেয়েও মোহময়, মায়াবী। দিগ-দিগন্তে, ইথারে ইথারে তারা শুনতে পান, হেনরি ডেভিড থরোর ভাষায়, "Different drummer" এর আহ্বান-ধ্বনি। ব্যাংকার ও লেখক আবদুল হামিদ এমনই ভিন্ন-মাদল শুনিয়ে সরণদ্বীপের একজন দুরন্ত অভিযাত্রী।
৩.
সম্প্রতি লেখক আবদুল হামিদ এর সাতরঙা ভারুয়াখালীর পাণ্ডুলিপি পড়লাম। পড়লাম না বলে উপভোগ করলাম বলাই বোধ হয় শ্রেয় হবে। আঞ্চলিক ইতিহাসের মতো কাষ্ঠং শুষ্কং বিষয়ের বইও যে কতটা সরস হতে পারে সেটার একটা উত্তম নমুনা হতে পারে এ বই। বইটির পরতে পরতে ছড়িয়ে আছে মধুর বিস্ময়। অধ্যায়ে অধ্যায়ে কালো অক্ষরে বপন করা আছে বিস্ময়-বীজ, লুকায়িত আছে তুতেনখামেনের গুপ্তধন (Tutankhamun’s Treasure)।
মোট পনেরোটি অধ্যায়ের এই বইয়ে লেখক কক্সবাজার সদরের ভারুয়াখালী নামক জনপদের বিগত চারশো বছরের ইতিহাসের সুলুক সন্ধান করেছেন। এ সুকঠিন কাজ করতে গিয়ে হোয়াইট কলার জব করা ব্যাংকার-কে যে রীতিমতো থিংকার হতে হয়েছে তা আমরা ভূমিকাতেই দেখতে পাই। গ্রন্থকারের নিষ্ঠা আর শ্রমের ব্যাপ্তি লেখকের কথার এই উক্তিতেই প্রতিফলিত: ‘বারবার মনে হতো, ‘ভারুয়াখালীর ইতিহাস শুরু কোথা থেকে?’ এই প্রশ্নের উত্তর খুঁজতে গিয়ে ইতিহাসের বই পড়া শুরু করি। রকমারি ডটকমসহ বিভিন্ন মাধ্যম থেকে প্রায় পঞ্চাশটির মতো ইতিহাসগ্রন্থ সংগ্রহ করে পড়েছি। যখনই কোনো বইয়ের রেফারেন্স পেতাম, সঙ্গে সঙ্গে সংগ্রহ করতাম।’
শুধুমাত্র একটা বই লিখতে গিয়ে লেখক রকমারি ডটকম ও অন্যান্য মাধ্যম থেকে কিনেছেন পঞ্চাশটা বই! জনাব হামিদ নিজেকে যেন রবীন্দ্রনাথের পয়লা নম্বর শীর্ষক ছোটগল্পের নায়ক অদ্বৈতচরণে পরিণত করেছেন যার জীবনের লক্ষ্য হলো প্রয়োজনে ‘ঋণং কৃত্বা বহিং পঠেৎ’ অর্থাৎ ঋণ করে হলেও বই পড়া। লেখকের এই আগ্রাসী পঠনপাঠন সাতরঙা ভারুয়াখালীর ছত্রে ছত্রে বিধৃত হয়েছে। পুরো বইটিই উৎসুক পাঠকের জন্য বিশেষত: কক্সবাজার আর চট্টগ্রাম অঞ্চলের পাঠকবৃন্দের জন্য বইবাহিক মনোতৃপ্তি, বুদ্ধিবৃত্তিক চিত্তপরিতোষ সাধন করে। এখানে বিশেষ করে তৃতীয়, চতুর্থ আর দ্বাদশ অধ্যায়ের কথা উল্লেখ করতে চাই। প্রসাদগুণে আর বিষয়চারিত্র্যে এই অধ্যায়ত্রয় যেকোনো পাঠকের মনোযোগ আকর্ষণ করবে।
তৃতীয় অধ্যায়ে লেখক ভারুয়াখালীর নামের উৎপত্তি সন্ধানে যে সচেতনতা আর সপরিশ্রম গবেষণা চালিয়েছেন তা আমাকে মুগ্ধ করেছে। ভারুয়াখালী নামের পা-িত্যপূর্ণ কিন্তু কৌতূহলোদ্দীপক উৎপত্তি-নির্ণয় আমাকে বারবার সুকুমার সেন এর বাংলা স্থাননাম বইটির কথা মনে করিয়ে দিয়েছে। প্রাসঙ্গিকভাবে লেখক চতুর্থ অধ্যায়ে কক্সবাজার নামের উৎপত্তি নিয়েও অনুসন্ধান চালিয়েছেন। দেশি পর্যটনের ভ্যাটিকান হওয়ায়, আমি মনে করি কক্সবাজার নামের উৎপত্তি বিষয়ক অংশটি যেকোনো অনুসন্ধিৎসু পাঠকের চিন্তা ও অনুভবকে ছুয়েঁ যাবে।
প্রাগুক্ত অধ্যায়ে লেখক আমার দীর্ঘদিনের একটি প্রশ্নের জবাব হাজির করেছেন। কক্সবাজারের অনেক জায়গার নামের শেষে ‘পালং’ শব্দটি আছে। যেমন কুতুপালং, রত্নাপালং, জালিয়াপালং ইত্যাদি। এর অর্থভেদ করার ইচ্ছে আমার অনেকদিনের। আমাদের জন্য লেখক জানাচ্ছেন পালং -এর শাব্দিক অর্থ হচ্ছে গ্রাম, বসতি, পাহাড়ি লোকবসতি ইত্যাদি।
লেখকের ভাষা সচেতনতা আর ইতিহাস চেতনা নতুন রসে জারিত হয় দ্বাদশ অধ্যায়ে। পুরো অধ্যায়টিই যেন ভারুয়াখালীর লোকাচারের মাধ্যমে বৃহত্তর চট্টগ্রামের জনজীবনের প্রতিনিধিত্বশীল অক্ষরচিত্র হয়ে উঠে। ভারুয়াখালীর লোকাচার বিষয়ক এ অধ্যায়টি আসলে এক অর্থে বিন্দুতে সিন্ধু এতে শুধু কক্সবাজার নয়, পুরো চট্টগ্রামের লোকাচারের শব্দচলচ্চিত্র নির্মিত হয়েছে। ভারুয়াখালীর জনজীবনের সামাজিক, ধর্মীয় আর সাংস্কৃতিক চিত্র তুলে ধরতে গিয়ে লেখক তুলে এনেছেন অনেকগুলো লোকাচার-সংশ্লিষ্ট শব্দ যেগুলো চাটগাঁর জনজীবন থেকে বিলুপ্ত বা বিলুপ্তপ্রায়- যেমন, হঁলা (অঁলা), বৈরাত, পানছল্লা, ঘাটাধরানি (ঘাডাধরানি), পাকা কথা (পাক্কা হথা), ফিরাফিরি, ফর্দ্দ, দুরুস কুরা, পোয়া ধরনি, পোয়া হামানি, তিন দিন্না, সাত দিন্না, হাইল্যা সাইর (আইল্যা সাইর), হালদা ফাটা (আলদা ফাডা) ইত্যাদি। এই শব্দগুলো বিয়ে, সন্তান জন্ম এবং কৃষি শ্রমিকদের সাথে সম্পৃক্ত। পুরো অধ্যায়টি আসলে ভারুয়াখালী তথা বৃহত্তর চট্টগ্রামের লোকাচারের রীতিমতো একটি Ship of info। অত্র অঞ্চলের সামাজিক, ধর্মীয়, আর সাংস্কৃতিক আচার অনুষ্ঠানের বিষয়গুলো লেখক বেশ মুনশিয়ানার সাথে অক্ষরবন্দি করেছেন, অঁলা থেকে আইল্যা সাইর কোনোটাই বাদ পড়েনি। জেমস ডিটজের মতো লেখক হয়তো বিশ্বাস করেন, ÔHistory is recorded in many ways. The past can be seen most fully by studying the small things so often forgotten’.
৪.
আবদুল হামিদের একাডেমিক পড়াশোনা ইংরেজি ভাষা ও সাহিত্যে। ইতিহাস বিষয়ে তাঁর কোনো বিশেষায়িত প্রাতিষ্ঠানিক অধ্যয়ন বা ডিগ্রি নেই। আমার মনে হয়, জনাব হামিদ হয়তো ক্যারল ক্যামনের On Doing Local History বা ডনাল্ড ডিন পার্কারের Local History: How to Gather It, Write It and Publish It পড়েননি। এতদসত্ত্বেও তিনি তাঁর সাতরঙা ভারুয়াখালী শীর্ষক এই Voyage long and strange সাফল্যের সাথে সম্পন্ন করেছেন, গন্তব্যে নোঙর ফেলেছেন। এ যেন ময়রার প্রশিক্ষণ ছাড়াই উপাদেয় মিষ্টান্ন তৈরির মতোই দুরূহ কাজ, যা তিনি নিপুণভাবে সম্পাদন করেছেন। মনস্বী পাঠকের জন্য পুরো বইটিই রসে টইটম্বুর এক রসগোল্লা। স্মৃতিপ্রত্ম খুঁড়ে এ বই কিছুটা বেদনা জাগায় আর আমাদের সময়-ভ্রমণে নিয়ে যায় অতীত নামের সে ভিনদেশে। সাতরঙা ভারুয়াখালী সত্যি এক ভোরের নরম আলোয় কচি নেবুর অলৌকিক ঘ্রাণ এ যেন বটের লাল ফল আর ভাঁটফুলের শুভ্র রঙিন হাসির মোহনীয় রসায়ন।
এত সুন্দর গ্রন্থ রচনার জন্য আমি লেখক আবদুল হামিদকে অভিনন্দন জানাই। তিনি আরও সুন্দর সুন্দর কাজের মাধ্যমে জগতের আনন্দযজ্ঞে রুচিশীল পাঠকের নিমন্ত্রণ রোশনাই করুন। তা-তা-থই সুন্দর দিন সদা বিরাজ করুক লেখকের দখিনা জানালায়।
ডঃ সরওয়ার মোরশেদ
অধ্যাপক, ইংরেজি বিভাগ
চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়
আগস্ট, ২০২৫