দর্শনের অন্যতম শাখা রাষ্ট্রদর্শন একটি রাষ্ট্রের নির্বাচনি ব্যবস্থা থেকে শুরু করে শাসনব্যবস্থার নৈতিক ও দার্শনিক ভিত্তি নিয়ে আলোচনা করে থাকে। রাষ্ট্রদর্শনে পিআর পদ্ধতি কেবল একটি নির্বাচন-ব্যবস্থা, নয়; বরং এটি প্রতিনিধিত্বশীল গণতান্ত্রিক সরকারের ধারণার সাথে সম্পর্কিত। লেখক এ গ্রন্থটিতে পিআর পদ্ধতি নিয়ে বাংলাদেশের প্রেক্ষাপটে যে সুচিন্তিত দার্শনিক বিশ্লেষণ উপস্থাপন করেছেন, তা নিঃসন্দেহে গবেষক ও সাধারণ পাঠকের জন্য এক নতুন সংযোজন।
কিছু রাজনৈতিক দল ও পলিসি বিশেষজ্ঞ কর্তৃক বাংলাদেশে পিআর পদ্ধতির দাবি এখন জোরেশোরে উঠেছে, কিছুদিন পর হয়তো থেমে যাবে, আবারও হয়তো এ দাবি মাথাচাড়া দেবে কিন্তু তাতে কি বাংলাদেশের দীর্ঘস্থায়ী রাজনৈতিক অচলাবস্থার স্থায়ী সমাধান হবে-এমন নিশ্চয়তা সত্যিই কি আছে? লেখক মূলত বোঝাতে চেয়েছেন বাংলাদেশের বিদ্যমান রাজনৈতিক বন্দোবস্তেরই কাঙ্ক্ষিত পরিবর্তন ও মৌলিক সংস্কার ছাড়া দীর্ঘমেয়াদি স্থিতিশীলতা সম্ভব নয়। আর প্রকৃত অর্থে এর বাস্তবায়ন করা সম্ভব হলেই কেবল নির্বাচনি ব্যবস্থা সেই আদলে স্বয়ংক্রিয়ভাবে পরিবর্তিত হবে। রাজনৈতিক দলগুলোর সদিচ্ছা, নির্বাচনের সাথে সংশ্লিষ্ট সকলের স্বচ্ছতা ও দায়িত্বশীলতা এবং যথাযথ নাগরিক সচেতনতার নিশ্চয়তা-এই তিনটি শক্তির সম্মিলন থাকলে পিআর হোক আর এফপিটিপি, যে পদ্ধতিই প্রয়োগ হোক, কাঙ্ক্ষিত প্রতিনিধিত্বশীল গণতান্ত্রিক ব্যবস্থা গড়ে তোলা সম্ভব। একটি অবাধ, নিরপেক্ষ, স্বচ্ছ ও অন্তর্ভুক্তিমূলক নির্বাচন তখনই সম্ভব, যখন উৎকৃষ্ট আইনি ও প্রাতিষ্ঠানিক কাঠামো, রাজনৈতিক সদিচ্ছা, নাগরিক সচেতনতা, স্বচ্ছ প্রযুক্তি ও দেশি-বিদেশি পর্যবেক্ষণ একত্রে কার্যকর হয়। তা না হলে পৃথিবীর ইতিহাসের ঐতিহাসিক অভিজ্ঞতা আমাদের বলে, স্বৈরাচার ও স্বেচ্ছাচারিতার বিরুদ্ধে গণঅভ্যুত্থান সংগঠিত হয়ে স্বৈরাচার পতনের মুখে পড়ে; কিন্তু স্বৈরাচারী কাঠামো অপরিবর্তিত থাকায় ক্ষমতার শূন্যস্থান প্রায়শই নতুন স্বৈরতান্ত্রিক শাসকের মাধ্যমেই পূরণ হয়, যা পূর্ববর্তী ব্যবস্থার পুনরাবৃত্তি বা পুনর্জন্মের আকারে আবির্ভূত হয় মাত্র।
'বাংলাদেশের প্রেক্ষাপটে পিআর পদ্ধতি: জন স্টুয়ার্ট মিলের তত্ত্বালোকে সম্ভাবনা, সংকট ও উত্তরণের উপায়'-লেখকের প্রথম গ্রন্থ, যেখানে তিনি বাংলাদেশের রাজনৈতিক অঙ্গনের বহুল আলোচিত একটি দাবি কীভাবে রাষ্ট্রদর্শনের সাথে প্রাসঙ্গিক হতে পারে তা পাঠকের সামনে তুলে ধরেছেন। গ্রন্থটিতে পিআর পদ্ধতি প্রয়োগের ফলে বাংলাদেশে কী ধরনের সম্ভাবনা তৈরি হতে পারে, কী ধরনের সংকট তৈরি হতে পারে, আবার সংকট থেকে উত্তরণের সম্ভাব্য উপায় সম্পর্কে একাডেমিক অঙ্গন থেকে শুরু করে সাধারণ পাঠকের কাছে অত্যন্ত সহজ ও সাবলীলভাবে উপস্থাপন করা হয়েছে। লেখকের এই প্রয়াস ভবিষ্যৎ গবেষণা ও পাঠকের জন্য মূল্যবান হয়ে উঠুক-সুদীর্ঘ গবেষণা ও সৃজনশীল প্রয়াসের জন্য নিরন্তর শুভকামনা রইল।