সমুদ্রের অবিরাম তরঙ্গের মতো একটার পর একটা ঘাত-অভিঘাত, উত্থান-পতনের মধ্যে অকুতোভয় এক সংগ্রামী মানুষ। যাঁর সরলতা এবং একই সঙ্গে অসম্ভব দৃঢ়তা আমাদের সামনে উজ্জ্বলই শুধু নয়, অনুকরণীয় হয়ে আছে। তিনি সরদার ফজলুল করিম। অধ্যাপনা যেমন ছিল তাঁর ব্রত, দর্শনচর্চার জন্য তাঁর খ্যাতি যেমন দিগন্তবিস্তারী; অন্যদিকে বাংলাদেশে সমাজতান্ত্রিক রাষ্ট্র প্রতিষ্ঠার লড়াইয়ে নির্ভীক ব্যক্তিত্ব। বরং জ্ঞানচর্চা, শিক্ষকতা-সব কিছুর ঊর্ধ্বে সরদার স্যারের রাষ্ট্রচিন্তা, মানুষের মুক্তির জন্য সংগ্রাম এবং তাঁর আত্মত্যাগ। তবে তিনি দৃষ্টান্ত তৈরির জন্য কিছু করেননি। লোকদেখানোর অভিপ্রায় কখনোই তাঁর ছিল না।
স্বাধীন, বৈষম্যমুক্ত সমাজ নির্মাণের আরেক স্বপ্নসন্ধানী মানুষ নাজমা জেসমিন চৌধুরী। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে আধুনিক ভাষা ইনস্টিটিউটে শিক্ষকতা করেছেন। গবেষণার পাশাপাশি তিনি ছিলেন নাট্যকার, কথাসাহিত্যিক। অত্যন্ত অকালে, ৫০ বছর বয়সে, তিনি প্রয়াত হন। তাঁরই স্মরণে আয়োজিত স্মারক বক্তৃতা দিয়েছেন সরদার ফজলুল করিম। একজন সম্ভাবনাময় শিক্ষক, সাহিত্যিক এবং মার্কসীয় রাজনৈতিক দর্শনের চিন্তাবিদের স্মরণে সরদার স্যার কথা বলেছেন। সেই স্মৃতিকথা, সেই অভিজ্ঞতার টুকরো টুকরো আলো প্রজন্মের পর প্রজন্মকে অনুপ্রাণিত করবে বলে আমরা মনে করি।
এই বই কেবল স্মারক বক্তৃতা নয়, এটি মানুষের অগ্রযাত্রার এক ইতিহাস। যা আমাদের ঘোর অমানিশার ভেতর পথ দেখাবে। আলো দেবে।
মে ১, ১৯২৫- সালের পহেলা মে বরিশালের আটিপাড়া গ্রামের এক কৃষক পরিবারে জন্ম গ্রহণ করেন৷ বাবা খবিরউদ্দিন সরদার কৃষিকাজ করতেন৷ মা সফুরা বেগম ছিলেন গৃহিণী৷ তাঁরা দুই ভাই তিন বোন৷ সরদার ফজলুল করিমের শৈশবকাল কেটেছে গ্রামে৷ ম্যাট্রিকুলেশন শেষে তিনি প্রথম ঢাকা আসেন ১৯৪০ সালে। ঢাকায় ১৯৪২ সনে তিনি তার আই.এ. পাঠ সমাপ্ত করে, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে ভর্তি হন। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় থেকে তিনি ১৯৪৫ সনে দর্শনশাস্ত্রে অনার্স ও ১৯৪৬ সনে এম.এ. ডিগ্রি লাভ করেন। ১৯৪৬ সাল থেকে ১৯৪৮ সাল পর্যন্ত তিনি ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে দর্শনশাস্ত্রে শিক্ষক হিসেবে নিয়োজিত ছিলেন। পরবর্তীতে তার সাম্যবাদী বামপন্থী সামাজিক-রাজনৈতিক আন্দোলনে যুক্ত থাকার পর্যায়ে পাকিস্তান সরকার কর্তৃক নিগৃহীত হন। রাজবন্দি হিসেবে দীর্ঘ ১১ বৎসর বিভিন্ন পর্যায়ে কারাজীবন যাপন করেন। জেলে থাকা অবস্থাতেই ১৯৫৪ সনে তিনি পাকিস্তান সংবিধান সভার সদস্য হিসেবে কাজ করেন। পরে ১৯৬৩ থেকে '৭১ সাল পর্যন্ত বাংলা একাডেমির সংস্কৃতি বিভাগের অধ্যক্ষ হিসেবে কাজ করেন। ১৯৭১ সালের সেপ্টেম্বর মাসে তিনি পাকিস্তান হানাদারবাহিনী কর্তৃক গ্রেফতার হন। পরবর্তিতে তিনি আবার ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে ১৯৭২ থেকে ১৯৮৫ সাল পর্যন্ত শিক্ষক হিসেবে শিক্ষাদান শুরু করেন। তিনি ১৫ জুন, ২০১৪ তারিখে ঢাকার শমরিতা হাসপাতালে চিকিৎসাধীন অবস্থায়মারা যান৷