বিভা — জীবনানন্দ দাশের অন্যতম অনন্য এবং বিতর্কিত উপন্যাস। এটি তাঁর মৃত্যুর অনেক পরে, ১৯৯৫ সালে প্রথমবার গ্রন্থাকারে প্রকাশিত হয়। এই উপন্যাসে মিশে আছে জীবনানন্দের কবিসুলভ চেতনা, অন্তর্দ্বন্দ্ব, এবং এক অন্তঃসারশূন্য সমাজে মানবিক সম্পর্কের সূক্ষ্ম টানাপোড়েন।
বিভা মূলত একটি একক পুরুষ চরিত্র—তপন—এর আত্মপলব্ধির কাহিনি। শহরের নির্জনতা, নিঃসঙ্গতা ও যৌনতা নিয়ে তাঁর মনোজগতে যে সংঘর্ষ ও প্রশ্ন জাগে, তারই সাহসী বর্ণনা রয়েছে এই উপন্যাসে। তপনের কল্পনার বিভা, তার প্রণয়, প্রেম, আকাঙ্ক্ষা, দ্বিধা ও সমাজসংকোচ—সব মিলিয়ে এই উপন্যাস এক ধূসর, কিন্তু তীব্র বাস্তব অভিজ্ঞতা তৈরি করে।
এই উপন্যাসটিও জীবনানন্দের অন্য লেখার মতোই প্রচলিত কাহিনির গঠন ভাঙে—এখানে নেই স্পষ্ট শুরু বা শেষ, নেই নাটকীয় মোচড়, বরং রয়েছে একটি স্রোতের মতো মনোজগতিক যাত্রা। উপন্যাসে যৌনতা এবং পুরুষ-নারী সম্পর্ক নিয়ে যে খোলামেলা ও জটিল মনস্তাত্ত্বিক বিশ্লেষণ রয়েছে, তা তাঁর সময়ে সাহিত্যে বিরল ছিল। ফলে অনেকেই মনে করেন, "বিভা" ছিল সময়ের চেয়ে অনেক এগিয়ে থাকা একটি রচনা।
জীবনানন্দ দাশ তাঁর কবিতার মতো এখানেও গভীর নিঃসঙ্গতা, অস্তিত্বের সংকট ও সমাজের মানসিক গোঁড়ামির বিরুদ্ধে এক নীরব প্রতিবাদ রেখেছেন। এখানে ‘বিভা’ চরিত্রটি কোনো স্পষ্ট নারী নয়, বরং এক প্রতীক—যা হতে পারে প্রেম, আকাঙ্ক্ষা, অথবা শুধুই এক উপলক্ষ আত্মানুসন্ধানের।
উপন্যাসটি পড়তে গেলে পাঠককে প্রস্তুত থাকতে হয় এক অন্তর্মুখী ভ্রমণের জন্য, যেখানে বাহ্যিক ঘটনাক্রমের চেয়ে অনেক বেশি গুরুত্বপূর্ণ হয়ে ওঠে চরিত্রের অন্তর্জগত।
বিভা সেই সমস্ত সাহসী সাহিত্যের অন্তর্গত, যেগুলো প্রচলিত ছাঁচে ফেলা যায় না—যার পাঠ একবার শুরু করলে পাঠক নিজেকে খুঁজে পেতে পারেন এক সম্পূর্ণ নতুন আলো-ছায়ার ভেতর।
জন্ম-(ফেব্রুয়ারি ১৮, ১৮৯৯ - বঙ্গাব্দ ফাল্গুন ৬, ১৩০৫ - কার্তিক ৫, ১৩৬১) ছিলেন বিংশ শতাব্দীর অন্যতম প্রধান আধুনিক বাঙালি কবি, লেখক, প্রাবন্ধিক এবং অধ্যাপক। তাকে বাংলাভাষার "শুদ্ধতম কবি" বলে আখ্যায়িত করা হয়ে থাকে। তিনি বাংলা কাব্যে আধুনিকতার পথিকৃতদের মধ্যে অগ্রগণ্য। মৃত্যুর পর থেকে শুরু করে বিংশ শতাব্দীর শেষ ধাপে তিনি জনপ্রিয়তা পেতে শুরু করেন এবং ১৯৯৯ খ্রিস্টাব্দে যখন তার জন্মশতবার্ষিকী পালিত হচ্ছিল ততদিনে তিনি বাংলা সাহিত্যের জনপ্রিয়তম কবিতে পরিণত হয়েছেন। তিনি প্রধানত কবি হলেও বেশ কিছু প্রবন্ধ-নিবন্ধ রচনা ও প্রকাশ করেছেন। তবে ১৯৫৪ খ্রিস্টাব্দে অকাল মৃত্যুর আগে তিনি নিভৃতে ২১টি উপন্যাস এবং ১০৮টি ছোটগল্প রচনা গ্রন্থ করেছেন যার একটিও তিনি জীবদ্দশায় প্রকাশ করেননি। তাঁর জীবন কেটেছে চরম দারিদ্রের মধ্যে। বিংশ শতাব্দীর শেষার্ধকাল অনপনেয়ভাবে বাংলা কবিতায় তাঁর প্রভাব মুদ্রিত হয়েছে। রবীন্দ্র-পরবর্তীকালে বাংলা ভাষার প্রধান কবি হিসাবে তিনি সর্বসাধারণ্যে স্বীকৃত। তাকে বাংলাভাষার শুদ্ধতম কবি অভিধায় আখ্যায়িত করা হয়েছে। তিনি (অক্টোবর ২২, ১৯৫৪ -বঙ্গাব্দ কার্তিক ৫, ১৩৬১ ) সালে মৃত্যু বরণ করেন।