আমি গ্রামের ছেলে। আমার জীবন গানের পাতায় পাতায় তা বলেছি। আমার মতো অতিসাধারণ মানের একটা ছেলে বাইরে দেখার স্বপ্নে বিভোর থাকত। তার কল্পনার রাজ্যে সংসারের নিত্যকার টানাপোড়েন আর অভাব থেকে বেরিয়ে আসার প্রতিজ্ঞা মুষ্টিবদ্ধ হতো, তখন হয়তো সৃষ্টিকর্তার করুণার হাতও আমাকে ছায়া দিত।
দিরাই, কখনো সিলেট শহর, কখনো মৌলভীবাজার, কখনো মুইগড় গ্রামের প্রায় অনিশ্চিত আটপৌরে দারিদ্র্যের জীবন দেখে শৈশব থেকেই এই বিরুদ্ধ-ক্লিষ্ট জীবনের সীমাহীন দুর্ভোগ ও দারিদ্র্যের হাত থেকে বাঁচার জন্য নিজেকে মনে মনে প্রস্তুত রাখতাম। শৈশবের দুরন্ত জীবনের আড়ালে একটাই জেদ মনের ভেতর পুষতাম, আমাকে দারিদ্র্য থেকে মুক্ত হতে হবে। নিজের, মা-বাবা, পরিবারের সচ্ছলতার জন্যে আমাকে যত পরিশ্রমই করতে হোক না কেন, তা করব। এবং সকল উপার্জন নীতিনৈতিকতা ও হালাল উপার্জনের মাধ্যমে হতে হবে।
‘এক জীবনের গান’ এ অকপটে আমার জীবনকথা খুলে বলেছি শুধু একটি আকাক্সক্ষায়, তা হলো, আমার এই জীবন গল্প পড়ে যদি একজন তরুণকেও উদ্বুদ্ধ করতে পারি সেটাই হবে ক্ষুদ্র জীবনের সার্থকতা।
নিজের প্রতি আত্মবিশ্বাস, দৃঢ় মনোবল, লক্ষ্য অর্জনের স্থিরতা একজন সাধারণকে অসাধারণ করে তুলতে পারে, সম্ভাবনার সকল দুয়ার খুলে আমাদের প্রিয় দেশকে অনেক উঁচুতে নিয়ে যেতে পারে। আমার এই লেখার পেছনে সেটাই মূল উদ্দেশ্য।
জীবন একটি চলমান স্রোত, হাজার বাধা পেরিয়ে এই স্রোতকে সমুদ্রে নিয়ে যেতে হবে। হয়তো ‘এক জীবনের গান’ এর সার্থকতা সেখানেই।
সালেহ হোসেন একজন আন্তর্জাতিক খ্যাতিসম্পন্ন ফার্মাসিউটিক্যাল বিজ্ঞানী। বিশ্বের অন্যতম সেরা ফার্মাসিউটিক্যাল কোম্পানি, কানাডার বায়োভেইল, আনা ফার্মা, ফার্মা মেডিকো, সিনফার, আইসো অ্যনালাইটিকায় তিনি একজন ফার্মাসিউটিক্যাল রিসার্চার হিসেবে নিরলস কাজ করে খ্যাতি লাভ করেন। গবেষণার নিষ্ঠা তাঁকে ১৯৯২-৯৬ পর্যন্ত কানাডা তথা বিশ্বের অন্যতম সেরা ফার্মাসিউটিক্যাল কোম্পানি আইসো অ্যানালাইটিকার প্রেসিডেন্ট ও প্রধান কার্যনির্বাহী পদে অধিষ্ঠিত করে। এই উপমহাদেশের তিনিই প্রথম বাঙালি এই পদে অধিষ্ঠিত হন। শিক্ষা, যোগাযোগ ব্যবস্থা ও সুযোগ-সুবিধা বঞ্চিত প্রান্তিক এলাকা সিলেটের গোয়াইনঘাটের ডৌবাড়ি ইউনিয়নের মুইগড় গ্রামে ড. সালেহ হোসেন জন্মগ্রহণ করেন। শৈশব থেকেই দারিদ্র্যের সাথে যুদ্ধ করে তিনি বেড়ে ওঠেন। সিলেটের দিরাই সরকারি উচ্চ বিদ্যালয় থেকে ১৯৬২ সালে মেট্রিকুলেশন পরীক্ষা, একই জেলার ঐতিহ্যবাহী এমসি কলেজ থেকে ১৯৬৪ সালে উচ্চমাধ্যমিক পরীক্ষা পাশ করার পর একই কলেজ থেকে তিনি কেমিস্ট্রিতে স্নাতক পাশ করেন। কিন্তু ১৯৬৯ সালে মাস্টার্স ডিগ্রিতে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় থেকে অ্যাপ্লাইড কেমিস্ট্রিতে প্রথম শ্রেণিতে পাশ করে সবাইকে তাক লাগিয়ে দেন। ১৯৯২ সালে ড. সালেহ হোসেন কানাডার আলবার্টা ইউনিভার্সিটি থেকে ফার্মাসিউটিক্যাল সায়েন্সে পিএইচডি ডিগ্রি লাভ করেন। নানা চড়াই-উতরাই ও ঘাত-প্রতিঘাতের মধ্য দিয়ে প্রতিষ্ঠা পাওয়া ড. হোসেন কানাডার আলবার্টা ইউনিভার্সিটির ‘আলবার্টা হেরিটেজ’ পুরস্কার ও ‘আলবার্টা ইউনিভার্সিটি প্রেসিডেন্ট’ স্কলারশিপ অর্জন করেন। বর্তমানে তিনি আমেরিকান অ্যাসোসিয়েশন অব ফার্মাসিউটিক্যালস সায়েন্টিস্টস (এএপিএস), আমেরিকান সোসাইটি অব মাস স্পেকট্রোমেট্রি, আমেরিকান অ্যাসোসিয়েশন অব ক্লিনিক্যাল রিসার্চ প্রফেশনালস এবং ইন্টারন্যাশনাল সোসাইটি ফর দ্য স্টাডি অব জেনোবায়োটিক্স-এর সদস্য। তিনি ইউরোপ, আমেরিকাসহ বিশ্বের বহু দেশে একজন ফার্মাকোলজি বিশেষজ্ঞ হিসেবে সভা ও সেমিনারে অংশগ্রহণ করেন।