কিশোরদের জন্য বিভূতিভূষণের লেখা দ্বিতীয় উপন্যাস মরণের ডঙ্কা বাজে। এ উপন্যাসে বিভূতিভূষণের যুদ্ধবিরোধী মানসিকতার প্রকাশ অত্যন্ত স্পষ্ট। রাজতন্ত্রী জাপানিদের দ্বারা যখন চীন আক্রান্ত হয়েছিল, সেই পরিবেশ-ঘটনা ও পটভূমিকায় গড়ে উঠেছে উপন্যাসটি।
গ্রামীণ পটভূমিকায় লেখা বিপিনের সংসার বিভূতিভূষণের ব্যতিক্রমধর্মী একটি উপন্যাস। অশিক্ষা ও স্বাস্থ্যহীনতায় জর্জরিত মানুষেরা যে গ্রামে নিরানন্দ একঘেয়ে জীবনযাপন করে, এ উপন্যাস তাদের ইতিহাস। কিন্তু এই পিছিয়ে থাকা মানুষদের মধ্যেও বিপিন নামক একটি মানুষের উন্নত জীবনচেতনায় উপনীত হবার কথা এ রচনার উল্লেখযোগ্য প্রান্ত।
স্বপ্ন ও বাস্তবতার বৈপরীত্যে জীবনে নেমে আসা বিপর্যয় ও যন্ত্রণার পটভূমিকায় রচিত উপন্যাস দুই বাড়ি। জীবনের তল ও সীমা যে অনেক বিস্তৃত এবং সেখানে স্বপ্ন ও বাস্তবতার সংঘাতে মানুষ যে প্রতিনিয়ত আলোড়িত-বিচলিত হয়, তার এক বেদনাময় চিত্র লক্ষ করা যায় আখ্যানে।
মিসমিদের কবচ ছোটদের জন্য লেখা গোয়েন্দা কাহিনি। মিসমিদের কবচের মাহাত্ম্যই উপন্যাসে গুরুত্ব পেয়েছে, গোয়েন্দা কাহিনি হিসেবে তেমন উত্তুঙ্গ কোনো উত্তেজনা এতে লক্ষ করা যায় না।
শিক্ষকদের জীবন নিয়ে লেখা বিভূতিভূষণের অনুবর্তন উপন্যাস বাংলা সাহিত্যের ক্ষেত্রে এক অভিনব দৃষ্টান্ত। বিভূতিভূষণের শিক্ষকতাজীবনের সঙ্গে অনুবর্তন-এর যোগসূত্র রয়েছে বলে অনেকে মনে করেন। দীর্ঘদিন বিভূতিভূষণ শিক্ষকতার চাকরি করেছেন। বস্তুত তাঁর প্রথম চাকরিই ছিল শিক্ষকতার। কলোনিয়াল ভারতে শিক্ষকজীবনের এক ঐতিহাসিক দলিল হিসেবে অনুবর্তন-এর গুরুত্ব অপরিসীম।
বাংলা সাহিত্যের অন্যতম পথিকৃৎ বিভূতিভূষণ বন্দ্যোপাধ্যায় বেশ কিছু কালজয়ী উপন্যাস রচনার মাধ্যমে জয় করে নিয়েছেন বাংলা ভাষাভাষী পাঠকদের হৃদয়। শুধু উপন্যাসই নয়, এর পাশাপাশি তিনি রচনা করেছেন বিভিন্ন ছোটগল্প, ভ্রমণকাহিনী, দিনলিপি ইত্যাদি। প্রখ্যাত এই সাহিত্যিক ১৮৯৪ সালের ১২ সেপ্টেম্বর ভারতের পশ্চিমবঙ্গের চব্বিশ পরগণা জেলায় জন্মগ্রহণ করেন, তবে তাঁর পৈতৃক নিবাস ছিল যশোর জেলায়। অত্যন্ত মেধাবী ছাত্র হিসেবে তিনি শিক্ষাজীবন অতিবাহিত করেন, যার প্রমাণ পাওয়া যায় তাঁর প্রথম বিভাগে এনট্রান্স ও আইএ পাশ করার মাধ্যমে। এমনকি তিনি কলকাতার রিপন কলেজ থেকে ডিস্টিংশনসহ বিএ পাশ করেন। সাহিত্য রচনার পাশাপশি তিনি শিক্ষকতার মাধ্যমে কর্মজীবন অতিবাহিত করেন। বিভূতিভূষণ বন্দ্যোপাধ্যায় এর বই সমূহ এর মধ্যে সবচেয়ে বিখ্যাত হলো 'পথের পাঁচালী', যা দেশ ছাড়িয়ে বিদেশের মাটিতেও ব্যাপক জনপ্রিয়তা লাভ করেছে বিভিন্ন ভাষায় অনূদিত হওয়ার মাধ্যমে। এই উপন্যাস অবলম্বনে চলচ্চিত্র নির্মাণ করে প্রখ্যাত চলচ্চিত্রকার সত্যজিৎ রায় অর্জন করেছেন অশেষ সম্মাননা। বিভূতিভূষণ বন্দ্যোপাধ্যায় এর বই এর মধ্যে আরো উল্লেখযোগ্য কয়েকটি হলো 'আরণ্যক', 'অপরাজিত', 'ইছামতি', 'আদর্শ হিন্দু হোটেল', 'দেবযান' ইত্যাদি উপন্যাস, এবং 'মৌরীফুল', 'কিন্নর দল', 'মেঘমল্লার' ইত্যাদি গল্পসংকলন। ১০ খণ্ডে সমাপ্ত ‘বিভূতি রচনাবলী’ হলো বিভূতিভূষণ বন্দ্যোপাধ্যায় এর বই সমগ্র, যেখানে প্রায় সাড়ে ছ’হাজার পৃষ্ঠায় স্থান পেয়েছে তার যাবতীয় রচনাবলী। খ্যাতিমান এই সাহিত্যিক ১৯৫০ সালের ১ নভেম্বর বিহারের ঘাটশিলায় মৃত্যুবরণ করেন। সাহিত্যে অসামান্য অবদানের জন্য তিনি মরণোত্তর 'রবীন্দ্র পুরস্কারে' ভূষিত হন।