জন্ম এবং মৃত্যুর মাঝখানে যে সময়, যাকে আমরা জীবন বলি, এই জীবনে একজন মানুষ যদি চেনা পরিমণ্ডলের বাইরে না-ও যায়, তার চিন্তা অনবরত ভ্রমণ করতে থাকে। পৃথিবীর একমাত্র প্রাণী মানুষ, যে কল্পনা করতে পারে, স্বপ্ন দেখতে পারে, এই স্বপ্ন তাকে ভ্রমণতাড়িত করে।
সেইন্ট অগাস্টিন বলেছেন পৃথিবী একটি বিশাল গ্রন্থ; যে ভ্রমণ করে না, সে এই গ্রন্থের কেবল একটি পৃষ্ঠাই পাঠ করল। আমি তো পুরো বইটাই পড়তে চাই। ছেলেবেলা থেকেই আমার ভ্রমণতৃষ্ণা প্রবল। যখনই সুযোগ পেয়েছি ঘর ছেড়ে বেরিয়ে পড়েছি। পাশের গ্রামে, পাশের থানায়, পাশের জেলায়, এরপর সারা বাংলাদেশে এবং এক পর্যায়ে দেশের সীমানা পেরিয়ে আরও বহুদূরে। আমার মধ্যে শিশুকাল থেকেই একটি তাড়না কাজ করত, আমি যা দেখি—তা অন্যকেও দেখাতে চাই। দেখাবার জন্য হাতে একটা ক্যামেরা দূর-শৈশবে ছিল না, ছিল সহজলভ্য একটি কলম। খুব ছেলেবেলায় কল্পনার রথে চড়ে বেরিয়ে পড়তাম। সুন্দরবনে গিয়ে ছিলাম কিছুদিন, সেইসব কাল্পনিক ভ্রমণ-অভিজ্ঞতা লিখেছি পৃষ্ঠার পর পৃষ্ঠা। দূরের কোনো শহরে বা গ্রামে, কোনো আত্মীয়ের বাড়ি বেড়াতে গেলে ফিরে এসে চিঠি লিখতাম। সমস্ত চিঠি জুড়ে থাকত ভ্রমণের গল্প। স্কুলে পড়ার সময় সাতক্ষীরার একটি মেয়ের সঙ্গে পত্রমিতালি করতাম। ওর নাম ছিল পারু। পারুকে লিখতাম আমার বাস্তব-অবাস্তব ভ্রমণের গল্প।
হয়তো এভাবেই আমি একজন ভ্রমণ-লেখক হয়ে উঠি। পৃথিবীর অর্ধশতাধিক দেশ ভ্রমণের পর সহস্রাধিক পৃষ্ঠা ভ্রমণ-রচনা লেখার পরে, আজ যখন কোনো এক বাঙালি তরুণ প্যারিস কিংবা বার্লিন থেকে ই-মেইল পাঠিয়ে বলে—স্যার, আপনার ভ্রমণ পড়ে পড়ে স্বপ্ন দেখেছি একদিন ইউরোপে যাব, এখন আমি প্যারিসে, বার্লিনে সেটেল্ড, তখন মনে হয়, ভ্রমণ-রচনায় আমি শুধু ভিনদেশের ছবিই আঁকিনি, ওখানে হয়তো অজান্তেই রোপন করেছি হাজারো তরুণের স্বপ্নের বীজ।