"অনেক বিচিত্রের মধ্যে মানুষের চেয়ে বিচিত্র তো আর কোনদিন কিছু দেখিনি। সে বিচিত্রের মধ্যেই আমার অপরূপের দর্শন ঘটেছে। সব মানুষই একজন নন। আর একজন আছেন তাঁর মধ্যে। একজন যিনি কাজ করেন; বাঁচবার জন্য গলদঘর্ম দিবানিশি। যিনি আহার মৈথুন সন্তান পালনের মহান কর্তব্যে ব্যাপৃত প্রায় সর্বক্ষণ, এই জটিল সংসারে যাঁর অনেক সংশয়, ভয় প্রতি পদে পদে। অবিশ্বাস, সন্দেহ, বিবাদ, এইসব নিয়ে যে মানুষ, তাঁর মধ্যে আছেন আর একজন- তিনি কবি, সাহিত্যিক, পাঠক, শিল্পী, গায়ক, ভাবুক। এক কথায় যিনি রসপিপাসু।.... মানুষের এই অনুভূতির তীব্রক্ষণে সে বড় একলা। এ একাকীত্বের বেদনা, যত গভীর, আনন্দ তেমনি তীব্র।”
"আমি সংসারের বেড়াজালের মধ্যে থেকেও পথের ডাকে সাড়া না দিয়ে পারি না। পাখি যেমন কুলায় ছেড়ে দূরের আকাশে উড়ে যায়, পথের ডাক সেই রকমই আমার মনের পাখায় কাঁপন ধরিয়ে দেয়। একে কেউ যদি জীবনকে ফাঁকি দেওয়া বলে, পলাতক বলতে চায়, বলুক গিয়ে। আমি জানি, জীবনে কোথাও ফাঁকি দিয়ে সংসার থেকে মুক্তি পাওয়া যায় না। সংসার থেকে পালিয়ে গিয়ে জীবনে কেউ কোন মহৎ কাজ করতে পেরেছে বলেও মনে করি না।.... সেই পথের ডাকে আমি ঘর বিবাগী বৈরাগী না, বিশাল জীবনের অঙ্গনে, নিজেকে আর এক রকমের আবিষ্কার। নিজেকেই নতুন করে খুঁজে ফেরা।"
"মেঘ যায় গলতে, ঝর ঝর করতে। আমি যাই সুধার সন্ধানে। তীব্র বিষ আমার নাম-কালকূট। গরল আমার ধমনীতে। সেই কবিতার মত বলতে ইচ্ছে করে, 'চির সুখীজন ভ্রমে কি কখন/ ব্যথীর বেদনা বুঝিতে পারে?/ কি যাতনা বিষে, বুঝিবে সে কিসে/ কভু আশীবিষে দংশেনি যারে?' আমার দৌড়ঝাঁপ ছুটোছুটি যাই বলো, সেই কারণে। মরি যে। জ্বলি যে তাই আমি ভ্রমি সুধার সন্ধানে। বাঁচতে কে না চায়? মানুষ তো বহুত দূর, ওটা জীবের ধর্ম। হতে পারি কালকূট। তা বলে অমৃতের সন্ধানে যাব না। এই আকন্ঠ বিষ নিয়ে বাঁচবো কেমন করে?"
সমরেশ বসু (১৯২৪-১৯৮৮) প্রখ্যাত ভারতীয় বাঙালি লেখক, ঔপন্যাসিক। কালকূট ও ভ্রমর তার ছদ্মনাম। তার রচনায় রাজনৈতিক কর্মকাণ্ড, শ্রমজীবী মানুষের জীবন এবং যৌনতাসহ বিভিন্ন অভিজ্ঞতার সুনিপুণ বর্ণনা ফুটে ওঠে। ১৯৮০ সালে তিনি সাহিত্য অকাদেমি পুরস্কার লাভ করেন। তার শৈশব কাটে বাংলাদেশের বিক্রমপুরে আর কৈশোর কাটে কলকাতার উপকণ্ঠ নৈহাটিতে। বিচিত্র সব অভিজ্ঞতায় তার জীবন ছিল পরিপূর্ণ। এক সময় মাথায় ফেরি করে ডিম বেচতেন। বিচিত্র বিষয় এবং আঙ্গিকে নিত্য ও আমৃত্যু ক্রিয়াশীল লেখকের নাম সমরেশ বসু। দেবেশ রায় তাঁর মৃত্যুতে লেখা রচনাটির শিরোনামই দিয়েছিলেন, 'জীবনের শেষদিন পর্যন্ত তিনি লেখক এবং পেশাদার লেখক'। ১৯৪৩ থেকে ১৯৪৯ সাল পর্যন্ত তিনি ইছাপুরের গান ফ্যাক্টরিতে কাজ করেন। ট্রেড ইউনিয়ন ও ভারতের কমিউনিস্ট পার্টির একজন সক্রিয় সদস্য ছিলেন তিনি। এ কারণে তাকে ১৯৪৯-৫০ সালে জেলও খাটতে হয়, জেলখানায় তিনি তার প্রথম উপন্যাস ‘উত্তরঙ্গ’ রচনা করেন। জেল থেকে মুক্তি পাওয়ার পর তিনি লেখালেখিকেই পেশা হিসেবে গ্রহণ করেন। কালকূট মানে তীব্র বিষ। এটি তাঁর ছদ্মনাম। 'অমৃত কুম্ভের সন্ধানে', 'কোথায় পাব তারে' সহ অনেক উপন্যাস তিনি এ নামে লিখেছেন। বহমান সমাজ থেকে বাইরে গিয়ে একান্তে বেড়াতে ঘুরে বেরিয়েছেন আর সে অভিজ্ঞতা নিয়ে লিখেছেন ভ্রমণধরমী উপন্যাস । হিংসা, মারামারি আর লোলুপতার বেড়াজালে আবদ্ধ থেকে যে জীবন দুর্বিসহ হয়ে উঠেছিল, সেখান থেকে বেড়িয়ে এসে অমৃতের সন্ধান করেছেন । তাই কালকূট নাম ধারণ করে হৃদয়ের তীব্র বিষকে সরিয়ে রেখে অমৃত মন্থন করেছেন উপন্যাসের মধ্য দিয়ে৷ “অমৃত বিষের পাত্রে”, “মন মেরামতের আশায়”, 'হারায়ে সেই মানুষে', 'তুষার শৃঙ্গের পদতলে' ইত্যাদি এই ধারার উপন্যাস। ছদ্ম নামে লেখা শাম্ব উপন্যাসের জন্য তিনি ১৯৮০ সালের আকাদেমি পুরস্কার পেয়েছিলেন। লেখক হিসেবে সমরেশ আমৃত্যু যে লড়াই করেছেন তার কোনো তুলনা নেই। তাঁর নিজের জীবনই আরেক মহাকাব্যিক উপন্যাস। 'চিরসখা' নামের প্রায় ৫ লাখ শব্দের বিশাল উপন্যাসে সেই লড়াইকে স্মরণীয় করে রেখেছেন তারই পুত্র নবকুমার বসু। ছোটদের জন্যে সৃষ্ট গোয়েন্দা গোগোল অত্যন্ত জনপ্রিয় হয়। গোগোলকে নিয়ে বহু ছোটগল্প ও উপন্যাস লিখেছেন যা শিশুসাহিত্য হিসেবে সমান জনপ্রিয়তা পেয়েছে। গোগোলের দুটি কাহিনী চলচ্চিত্রায়িতও হয়।