ভূমিকা
বেগম রোকেয়া ভারতীয় উপমহাদেশের একজন অনন্যসাধারণ সৃজনশীল লেখক, যিনি সামাজিক মূল্যবোধের জায়গা বিপুল পরিসরে উদ্ভাসিত করেছেন।
তাঁর জন্ম ১৮৮০ সালে। মৃত্যু ১৯৩২ সালে। তাঁর জন্ম-মৃত্যুর সময়ের পরিসরের আগে ও পরে সামাজিকভাবে নারীদের অবদমনের বিষয়টি ছিল একরৈখিক। পুরুষতান্ত্রিক সামাজিক অবস্থা নারীকে অবদমন করেছে নানাভাবে। বেগম রোকেয়া উনিশ শতকের সূচনা থেকে বিষয়টি তাঁর রচনায় তুলে ধরেছেন- এটি ছিল একটি দিক। অন্যটি ছিল মেয়েদের লেখাপড়ার সুযোগ তৈরি করার জন্য স্কুল প্রতিষ্ঠা করা। নারীদের অর্থনৈতিক মুক্তির চিন্তায় 'আঞ্জুমানে খাওয়াতীনে ইসলাম' স্থাপন করে মেয়েদের কুটিরশিল্পে নিয়োজিত করেছিলেন।
তিনি পরিষ্কার বলেছিলেন, 'আমরা অকর্মণ্য পুতুলজীবন বহন করিবার জন্য সৃষ্ট হই নাই, এই কথা নিশ্চিত।' তিনি আরও বলেছেন, 'কন্যাগুলিকে সুশিক্ষিত করিয়া কার্যক্ষেত্রে ছাড়িয়া দাও, নিজের অন্নবস্ত্র উপার্জন করুক।' নারী-পুরুষের সম অধিকারের ক্ষেত্রে তিনি বলেছেন, 'নারী-পুরুষ সমাজদেহের দুটি চক্ষুস্বরূপ। মানুষের সব রকমের কাজকর্মের প্রয়োজনেই দুটি চক্ষুর গুরুত্ব সমান।' আরও বলেছেন, 'তাহাদের জীবন শুধু পতি-দেবতার মনোরঞ্জনের নিমিত্তে উৎসর্গ হইবার বস্তু নহে! তাহারা যেন অন্নবস্ত্রের জন্য কাহারও গলগ্রহ না হয়।' আর মেয়েদেরকে নিজেদের দৃষ্টি খুলতে বলেছেন 'ভগিনীগণ! আপনারা স্বীয় কারাগারের ক্ষুদ্র ছিদ্রপথ দিয়া উঁকি মারিয়া একবার বাহিরের জগৎ দেখুন দেখি!'
শিক্ষা এবং অর্থনৈতিক স্বনির্ভরতা যেমন নারী-পুরুষ নির্বিশেষে ব্যক্তির জন্য জরুরি, তেমনি জনগোষ্ঠীর সার্বিক উন্নয়নের জন্যও প্রাথমিক ধাপ। এই দুই জায়গায় রোকেয়া যে নিজস্ব চিন্তার আলো ফেলেছিলেন, এখন থেকে একশ বছর আগে, আজকের পৃথিবীতে তা জেন্ডার সমতার জায়গা বিশ্লেষণের মৌলিক সূত্র। জেন্ডার সমতার যে সমাজমনস্ক চিন্তা পরিব্যাপ্তি হয়েছে তা কোনো তাত্ত্বিক উদ্ভাবন ছাড়াই রোকেয়া তাঁর আপন জ্ঞান ও প্রজ্ঞায়, অনুধাবন করেছিলেন। তিনি গত শতাব্দীর শুরুর দিকে যখন এই জায়গাগুলো চিহ্নিত করেছিলেন, তখন জেন্ডার ধারণার জ্ঞান একাডেমিক জগতে প্রবেশ করেনি। এখানেই রোকেয়াকে স্মরণ করার যৌক্তিক অনুশীলন প্রতিষ্ঠিত হয়।
'নির্বাচিত রচনাবলি' গ্রন্থে সংকলিত হয়েছে 'মতিচুর (প্রথম খণ্ড)', 'পদ্মরাগ', 'অবরোধ-বাসিনী', 'ছোট গল্প ও রস-রচনা'। তাঁর এসব লেখায় নানা বিশ্লেষণে রচনার বৈশিষ্ট্য প্রকাশিত হয়েছে। এজন্য বেগম রোকেয়াকে অবিরত স্মরণ করা প্রজন্মের আত্মশক্তি বিস্তারের নিখুঁত নির্যাস।
'মতিচুর' গ্রন্থে সংকলতি হয়েছে- 'পিপাসা', 'স্ত্রীজাতির অবনতি', 'নিরীহ বাঙালি', 'অর্ধাঙ্গী', 'সুগৃহিনী', 'বোরকা' ও 'গৃহ' নামক প্রবন্ধ। সবগুলো লেখায় তাঁর মননশীলতার স্ফুরণ ব্যাপ্তি হয়েছে, যা পাঠকের চেতনাকে সমৃদ্ধ করবে। প্রত্যেকেই নিজের ভাবনার জগৎ আলোকিত করতে পারবে।