‘মাসালিকুল আবসার ফি মামালিকিল আমসার’ হলো ভূগোল ও ইতিহাসের সমৃদ্ধ এক বিশ্বকোষ। সাধারণ জ্ঞানের বৃহৎ একটি গ্রন্থ। আল্লামা সফদির মন্তব্য হলো, ‘সংশ্লিষ্ট বিষয়ে এত সমৃদ্ধ কোনো গ্রন্থ আমি আর দেখিনি।’ গ্রন্থকার এটি ২৭ খণ্ডে সুবিন্যস্ত করে লিখেছেন। আরবি ভাষায় সাধারণ জ্ঞান বিষয়ের ওপর গ্রন্থ রচনা শুরু হয় হিজরি তৃতীয় শতকে। এই কাজে অগ্রগামী ছিলেন ইসলামি সালতানাতের কর্মচারী, সচিব, লেখক ও উজিরগণ।
গবেষকদের মতে, ইবনে কুতায়বা (মৃত.২৭৬ হি.)-এর উয়ুনুল আখবার সংশ্লিষ্ট বিষয়ের প্রথম রচনা। অষ্টম হিজরি শতকের সামসময়িক দুজন প্রসিদ্ধ সাহিত্যিক সাধারণ জ্ঞানের ওপর দুটো বৃহৎ গ্রন্থ রচনা করেন— নুওয়াইরি (মৃত. ৭৩৩ হি.) রচিত নিহায়াতুল আরব ফি ফুনুনিল আরব এবং ইবনে ফজলুল্লাহ উমরি আরও বৃহৎ পরিসরে রচনা করেন মাসালিকুল আবসার। ভূগোল ও মানব-ইতিহাসের বিশাল এই বিশ্বকোষ থেকেই ইবনে কালকাশান্দী সবচেয়ে বেশি উপকৃত হয়েছেন। ঐতিহাসিক সূত্র পর্যালোচনা, নগর ও নাগরিক সভ্যতা-সংক্রান্ত ধারণা পেশের ক্ষেত্রে লেখক ইবনে খালদুনের অগ্রপুরুষ ছিলেন। তিনি এই গ্রন্থটিকে দুভাগে বিভক্ত করেছেন :
প্রথম ভাগ : পৃথিবী ও তার মধ্যস্থিত জল ও স্থলভাগের আলোচনা।
দ্বিতীয় ভাগ : পৃথিবীর অধিবাসী ও জাতিগোষ্ঠীর আলোচনা।
প্রথম ভাগকে আবার তার ভাষায় দুটি ‘নওউ’-এ সাজিয়েছেন। প্রথম নওউ হলো, আল-মাসালিক; তথা পৃথিবীর পথঘাটের আলোচনা। আর দ্বিতীয় নওউ হলো, আল-মামালিক; তথা রাজ্য ও দেশসমূহের আলোচনা। প্রথম নওউ বা আল-মাসালিক-সম্পর্কিত আলোচনার জন্য তিনি পাঁচটি অধ্যায় সাজিয়েছেন। আর দ্বিতীয় নওউ বা আল-মামালিকের জন্য সাজিয়েছেন পনেরোটি অধ্যায়। আলোচ্য গ্রন্থের দ্বিতীয় ভাগ-তথা পৃথিবীর অধিবাসী ও জাতিগোষ্ঠীর অধ্যায়কে তিনি চারটি ‘নওউ’-এ সাজিয়েছেন :
(১) প্রাচ্য ও পাশ্চাত্যের বিষয়বস্তু ও জ্ঞানীসমাজের তুলনামূলক বিবরণ।
(২) বিভিনড়ব ধর্মবিশ্বাস ও মতবাদ।
(৩) বিভিন্ন ধর্মবিশ্বাসীদের আলোচনা।
(৪) পৃথিবীর ইতিহাস।
আর এই চতুর্থ ‘নওউ’-এ রয়েছে দুটি অধ্যায় :
(১) ইসলাম-পূর্ববর্তী যুগের বিভিন্ন রাজ্যের ইতিহাস।
(২) মুসলমানদের বিভিন্ন সালতানাতের ইতিহাস।
গ্রন্থকার হিন্দুস্তান-সম্পর্কিত অধ্যায়ে তৎকালীন সুলতান মুহাম্মদ বিন তুঘলক-এর আলোচনা করেছেন। মুহাম্মদ বিন তুঘলক ছিলেন ভারতবর্ষের ইতিহাসে এক মহান বাদশাহ। পিতা গিয়াসুদ্দিন তুঘলকের মৃত্যুর পর তিনি সিংহাসনে বসেন। ১৩২৫ থেকে ১৩৫১ ঈসাব্দ পর্যন্ত ভারতবর্ষ শাসন করেন। তিনি ছিলেন কুরআনুল কারীমের হাফেজ। ফিকহে হানাফির প্রসিদ্ধ গ্রন্থ ‘হেদায়া’ ছিল তার কণ্ঠস্থ। শরিয়তের হুকুম-আহকাম পালনে ছিলেন খুবই যত্নবান। শরিয়ত-পরিপন্থি কাজ, বিশেষত মদপানের ব্যাপারে ছিলেন খুবই কঠোর। ভারতবর্ষের আনাচেকানাচে ইসলাম প্রচারের ক্ষেত্রে তাঁর অবদান অনস্বীকার্য। এই হাফেজে কুরআন ও বিজ্ঞ আলেম বাদশাহ অমুসলিমদের অধিকার প্রতিষ্ঠায় ছিলেন সদা জাগ্রত। নাগরিক অধিকার প্রদানে তিনি মুসলিম ও অমুসলিমদের মধ্যে কোনো তারতম্য করেননি। কিছু কিছু ক্ষেত্রে বৈপ্লবিক পরিবর্তন আনায় তাকে পক্ষপাতদুষ্ট ঐতিহাসিকরা ‘পাগল’, ‘বিকৃত’ আর ‘রক্তপিপাসু’ এ ধরনের শব্দবাণে জর্জরিত করেছে। মূলত রাজ্যজয়ের পরিকল্পনা, রাজধানী দেবগিরিতে স্থানান্তর, দোয়াব এলাকায় অতিরিক্ত কর আরোপ ও তাম্রমুদ্রার প্রচলন ইত্যাদির কারণে ইতিহাসের পাতায় তাকে একজন খামখেয়ালি বাদশাহ হিসেবে আখ্যায়িত করা হয়েছে। অথচ নিরপেক্ষ ইতিহাস বিশ্লেষণে উল্লেখিত পরিকল্পনাগুলোর যথার্থতা বুঝে আসে।
আল্লামা ফজলুল্লাহ উমরি মূলত পরিব্রাজক, উলামা ও দূত প্রমুখের মৌখিক বর্ণনার ভিত্তিতে অধ্যায়টি সাজিয়েছেন। মনে হয়, সুলতানের দানশীলতা, ফৌজের সংখ্যা ও বেতন সম্পর্কে তারা কিছুটা অতিশয়োক্তি করেছেন। কিন্তু সামগ্রিক বিবেচনায় অধ্যায়টি খুবই গুরুত্বপূর্ণ। এতে তৎকালীন হিন্দুস্তানের ইতিহাস, জীবনযাত্রা ও অর্থনৈতিক বিষয়ে এমন সব বিরল তথ্য বর্ণিত রয়েছে, যা কোনো হিন্দুস্তানি ইতিহাসগ্রন্থে নেই। তা ছাড়া এই অধ্যায়ে সুলতান মুহাম্মদ বিন তুঘলকের শাসনব্যবস্থা, জনজীবনের এমন চিত্র ফুটে উঠেছে, যা তৎকালীন হিন্দুস্তানি ইতিহাস-গ্রন্থগুলোর প্রায় উলটো। এখানকার অধিকাংশ ঐতিহাসিক ও বিদেশি পর্যটকরা ব্যক্তি আক্রোশ, মাজহাবি ও রাজনৈতিক বিরোধের কারণে সুলতান ও তৎকালীন হিন্দুস্তানকে অন্যভাবে চিত্রিত করেছেন।
বাংলা অনুবাদের অন্যান্য বৈশিষ্ট্য
• মূল গ্রন্থে উল্লেখিত তৎকালীন হিন্দুস্থানের বিভিন্ন অঞ্চল চিহ্নিত করা হয়েছে।
• তৎকালীন যুগের হিন্দুস্তানি ফলমূল, খাবার, রাষ্ট্রীয় পদ-পদবী, মুদ্রা, খনিজ পদার্থ ইত্যাদির নামের তাহকিক ও আধুনিক নাম উল্লেখ করা হয়েছে।
• হিন্দুস্তান-সম্পর্কিত সমৃদ্ধ অধ্যায়টির সাথে মাসালিকুল আবসারের ২৩ তম খণ্ডের নির্বাচিত অংশ হিন্দুস্তানের জাতি-গোষ্ঠী এবং ২৫ তম খণ্ডের নির্বাচিত অংশ প্রাচীন হিন্দুস্তানের রাজাদের ইতিহাস-ও যুক্ত হয়েছে। মোটকথা, প্রাচীন ও মধ্যযুগের হিন্দুস্তানের ইতিহাস সম্পর্কে সালতানাতে হিন্দ হল অনন্য একটি উপহার।