রব্বানী দৃষ্টিতে গ্রন্থটি আবু জর গিফারি সোসাইটির পক্ষে ১৯৭০ সালে অধ্যাপক শাহেদ আলী প্রথম প্রকাশ করেন। বর্তমান গ্রন্থ তারই পুনঃপ্রকাশ। এ গ্রন্থে কয়েকটি রচনা সংকলিত হয়েছে। যেমন Ñ আল ফাতিহা, ইজতিহাদ, সমাজের জন্ম ও জীবন, সমাজ জীবনের গতি বৈচিত্র্য, সমাজ পুনর্গঠনের প্রয়োজনীয় ইসলামী মূল্যবোধ, ইসলাম ও অর্থনৈতিক সমস্যা, ইসলামী সংস্কৃতির অর্থ, ইসলামে পরিবারের মর্যাদা ও নারীর স্থান ইত্যাদি।
আবুল হাশিমের (২৭.০১.১৯০৫Ñ০৫.১০.১৯৭৪ ) পিতা আবুল কাসেম (০২.০২.১৮৭২- ১০.১০. ১৯ ৩৬) মন্টেগু চেমসফোর্ড সংস্কারের সময় থেকে আমৃত্যু (১৯১৯-৩৬) প্রাদেশিক বা কেন্দ্রীয় আইনসভার সদস্য ছিলেন। মৌলভী আবুল কাসেমের জীবনব্যাপী জনকল্যাণমুখী কাজের স্বীকৃতি হিসেবে বর্ধমানবাসী ভোট দিয়ে আবুল হাশিমকে বঙ্গীয় আইনসভার সদস্য নির্বাচিত করেন। ১৯৩৭ সালে কলকাতায় মহম্মদ আলী জিন্নাহর আহ্বানে মুসলিম লিগে যোগ দেন।
১৯৩৮ সালে আবুল হাশিম বর্ধমান জেলা মুসলিম লীগের সভাপতি নির্বাচিত হন। ১৯৪০ সালের ৩০ মার্চ লাহোরে অনুষ্ঠিত নিখিল ভারত মুসলিম লীগের অধিবেশনে যোগদান করেন। ১৯৪৩ সালের ৭ নভেম্বর কলকাতা মুসলিম ইনস্টিটিউটে অনুষ্ঠিত সভায় আবুল হাশিম বঙ্গীয় প্রাদেশিক মুসলিম লীগের সাধারণ সম্পাদক নির্বাচিত হন এবং মুসলিম লীগকে একটি গণতান্ত্রিক প্রগতিশীল দল হিসেবে গড়ে তোলার ঘোষণা দেন যা তিনি বাস্তবায়ন করেছিলেন। ১৯৪৪ সালের মধ্যে ৫ লক্ষের বেশি ২ আনার সদস্য সংগ্রহ করতে সক্ষম হন। প্রাদেশিক মুসলিম লিগের আফিস ও পার্টিহাউজ ছিল বাঙ্গালার মুসলিম যুব নেতৃবৃন্দের মিলনকেন্দ্র। জমিদার ও নবাবদের হাত থেকে সাধারণ মানুষের মুসলিম লিগ প্রতিষ্ঠা করেন তিনি।
সবুর খানের মতে, আবুল হাশিম বাঙ্গালার সন্ত্রাসবাদীদের সার্থে সম্পর্কিত এবং একজন কমিউনিস্ট। শাহ আজিজুর রহমানও আবুল হাশিমকে কমিউনিস্ট হিসেবে দোষারোপ করতেন। খাজা নাজিমুদ্দিন মনে করতেন, আবুল হাশিম ইসলামকে আশ্রয় করে কমিউনিজম প্রচার করেন। আবুল হাশিমের আদর্শবাদ বিষয়ে সুহরাওয়ার্দীও তেমন সমর্থন করতেন না। একবার তিনি হাশিমকে বলেছিলেন, ‘হাশেম আদর্শের প্রতি এত নিষ্ঠা আমার মনঃপুত নয়; আদর্শ আমার কর্মজীবনে কখনও কোনো কাজে আসেনি।’
আবুল হাশিম তাঁর জীবনের এই আদর্শ পেয়েছিলেন রসুলের নেতৃত্বে খেলাফতের পথ অনুযায়ী। তাঁর এই প্যান ইসলামিক চিন্তার অন্যতম উপাদান ছিল কমিউনিজমের সাথে ইসলামী সাম্যের সাযুজ্য অন্বেষণ। এই কারণে তাঁকে সব সময় বলা হয়েছে বামপন্থী। ১৯৫০ সালের এপ্রিল মাসে কলিকাতা ত্যাগ করে ঢাকা চলে আসেন।
১৯৫২ সালে রাষ্ট্রভাষা সংগ্রাম পরিষদের সদস্য নির্বাচিত হন এবং ২০ ফেব্রুয়ারি সংগ্রাম পরিষদের সভায় সভাপতিত্ব করেন। এ কারণে ১৯৫২ সালের ২৫ ফেব্রুয়ারি গ্রেফতার হন এবং ১৬ মাস কারাবরণ করেন। ১৯৫৩ সালে জেল থেকে মুক্তি পেয়ে খেলাফতে রব্বানী পার্টি গঠন এবং ১৯৫৬ পর্যন্ত এর নেতৃত্ব দেন। উল্লেখ্য, খেলাফতে রব্বানী পার্টি যুক্তফ্রন্ট নির্বাচনের (১৯৫৪) অলিখিত শরিক দল হিসেবে ২টি আসন লাভ করে। ১৯৬০ থেকে ১৯৭০ সাল পর্যন্ত তিনি ইসলামিক ফাউন্ডেশানের পরিচালক ছিলেন। ১৯৬৫ সালে অনুষ্ঠিত প্রেসিডেন্ট নির্বাচনে কনভেনশন মুসলিম লীগের প্রার্থী আইউব খানের প্রতি সমর্থন দেন। বঙ্গীয় প্রাদেশিক মুসলিম লিগের এই প্রাক্তন সাধারণ সম্পাদক আজীবন ইসলামের ভাবধারা অবলম্বন করে ছিলেন।
দুটো বিষয়ের সাথে আবুল হাশিম জোরালোভাবে সম্পৃক্ত হয়ে আছেন। এর একটি হচ্ছে লাহোর প্রস্তাব অনুযায়ী স্বাধীন রাষ্ট্রসমূহ গঠন এবং অন্যটি হলো স্বাধীন অবিভক্ত বাঙ্গালা গঠন। তিনি জিন্নাহ এবং গান্ধীর সাথে অনেক দরবার করেও বাঙ্গালাভাগ ঠেকাতে পারেননি এবং এক পাকিস্তানের বদলে দুটি স্বাধীন রাষ্ট্র গঠন করতে পারেননি যার জন্য তাঁর প্রচেষ্টা ছিল উল্লেখযোগ্য। তবে গান্ধী আবুল হাশিমের নিকট স্বীকার করেছেন যে, হাশিম যদি অন্ধ না হয়ে যেতেন তবে সম্ভবত বাঙ্গালা ভাগ করা সম্ভব হতোনা। শেষ পর্যন্ত কংগ্রেস ও হিন্দু মহাসভার নেতৃত্বে গান্ধী-নেহেরু-প্যাটেল- শ্যামাপ্রসাদের নির্দেশে, ভারতের কমিউনিস্ট পার্টি এবং কলকাতার সংবাদপত্র জগতের সমর্থনে বাঙ্গালা ভাগ হয়ে গেল।