শেক্সপীঅর অনুবাদের অসম্ভাব্যতায় দৃঢ়নিশ্চয় এমন ইংরেজি ভাষাভিজ্ঞ বাঙালির দর্শন দুর্লভ
নয়, যাঁদের কাছে এই মহাকবিকে অনুবাদ করার মতো পণ্ডশ্রম আর কিছু থাকতে পারে না।
পণ্ডশ্রম এই জন্যে যে, যাঁরা ইংরেজি জানেন এবং মূলের রসাস্বাদন করতে পারেন, অনুবাদ
তাঁদের কাছে মূলের দুর্গতির স্মারকমাত্র। এবং যাঁরা ইংরেজি জানেন না, সেই অপাঙ্ক্তেয়দের
জন্যে ভাবনার কারণ নেই, যেহেতু তাঁদের কাছে শেক্সপীঅরও যা মুচিরাম গুড়ও তাই।
কোনো ইংরেজ, ফরাসি, জার্মান, রুশীয় বা জাপানির মুখ থেকে অনুবাদ না করার এইরূপ
যুক্তি কল্পনাতীত ; তার একমাত্র কারণ, তারা তাদের ভাষার সঙ্গে অদ্বৈত। আমাদের কাছে
আমাদের ভাষাটা নিতান্তই মাতৃভাষা ; তাই তার স্থান অন্দরমহলে, মায়ের আঁচলে বাঁধা।
আফিসে, কাছারিতে, বহির্জগতের কর্মকাণ্ডের সব ক্ষেত্রে আজও সেই ভাষাকে ঘোমটা টেনে
চলতে হয়, যদিও আইনত এই ঘোমটা খুলে ফেলার অধিকার সে অর্জন করেছে। জন্মগত
অধিকারকে যখন আইনের জোরে প্রতিষ্ঠিত হতে হয়, তখন সে-অধিকারে ন্যায়বিচার
থাকলেও, ব্যবহারের সহজাত স্ফূর্তি থাকে না। ইংরেজ বা ফরাসি কল্পনাই করতে পারে না,
তাদের ভাষার থেকে বিচ্ছিন্ন অবস্থায় তাদের কোনো অস্তিত্ব আছে। ভাষার প্রতি এই মমত্ব,
এ বিধিবদ্ধ কোনো অধিকার নয়, এ তাদের সত্তার অপরিহার্য অঙ্গ। তাই তারা পরকে আপন
করে সাজাতে জানে, আপনকে দূরে ঠেলে গৌরববোধ করে না। তাই ফরাসী, জার্মান,
রুশীয়রা যখন নিজেদের ভাষায় শেক্সপীঅরকে অনুবাদ করে অভিনয় করে, তার দ্বারা
প্রমাণিত হয় না তাদের রসবোধ আমাদের মতো উন্নত নয়, তার দ্বারা প্রমাণ হয় তারা মূলের
ততটুকু রসাস্বাদনেই তৃপ্ত যতটুকু তাদের ভাষা তাদের কাছে পৌঁছিয়ে দিতে পারে।
এ-কথা
অবিসংবাদিত সত্য যে, মূলকে সম্পূর্ণভাবে আত্মসাৎ করার শক্তি কোনো ভাষারই নেই। তবু
স্বেচ্ছায় নিজেকে বঞ্চিত রেখে ভিন্নভাষী পাঠক অনুবাদককে তার দায়িত্ব সম্পর্কে সচেতন
রাখে। ভাষার এই বাহিকশক্তিকে আবিষ্কার করা সহজ কাজ নয়। এইজন্যে এই সব দেশে
অনুবাদ মৌলিক সাহিত্যের সমমর্যাদায় অধিষ্ঠিত এবং দেশের শ্রেষ্ঠ কথাশিল্পীরা অনুবাদকে
মূলানুগ করার কাজে ব্যাপৃত। তাই শেক্সপীঅরের এই চতুর্থ শতবর্ষ উদযাপনের লগ্নে,
পৃথিবীর সব দেশ যখন শেক্সপীঅরের সঙ্গে তাদের আত্মীয়তা স্মরণ করে আত্মপ্রসাদ লাভ
করছে, তখন আমরা তাঁকে মহাকবি বলে শ্রদ্ধা জানালেও, আত্মীয় বলে ভাবতে দ্বিধান্বিত।
তা এই চতুর্থ শতবার্ষিক শ্রদ্ধানুষ্ঠানের কর্মকাণ্ড থেকেই বোঝা যায়। আমাদের গবেষকরা
বাংলা সাহিত্যের ইতিহাস তন্ন তন্ন করে শেক্সপীঅরের ছিটেফোঁটা যদি কোথাও পাওয়া যায়
তার সন্ধানে ব্যস্ত, যাতে, বৃষোৎসর্গ না হলেও অন্তত তিলতর্পণটুকু করা চলে। অন্যদিকে
শেক্সপীঅর অভিনয়ের উৎসাহ অধিকাংশ ক্ষেত্রে হয় মূল ইংরেজিতে, নয়তো অপ্রচলিত
কোনো প্রাচীন অনুবাদে সীমাবদ্ধ।
এই প্রসঙ্গে মনে পড়ে বঙ্গীয় শেক্সপীঅর পরিষদের
প্রচেষ্টার কথা। ১৯৫১ সালে মুখ্যত শ্রদ্ধেয় নীরেন্দ্রনাথ রায়ের উৎসাহে এবং শেক্সপীঅর-
উৎসাহী বিদ্বজ্জনের সহযোগে এই পরিষদের প্রতিষ্ঠা হয়। ১৯৫২ থেকে ১৯৫৬ পর্যন্ত, অর্থাৎ
শ্রীযুক্ত রায়ের বিদেশগমনের পূর্ব পর্যন্ত, পরিষদ কলিকাতার নাট্যামোদী মহলে যে অভূতপূর্ব
গয় থাকত তাহলে এতদিনে বাংলায়