"লোকসাহিত্য" বইটির ভূমিকা থেকে নেয়াঃ বাংলাদেশ ফোকলোরের দিক দিয়ে এক সমৃদ্ধ অঞ্চল। এই অঞ্চলের নিরক্ষর জনগোষ্ঠী তাদের নিজস্ব সংস্কৃতিকে যেমন ভালোবাসে, তেমনি সেই সংস্কৃতিকে নিজেদের মধ্যে লালনের যে-নিষ্ঠা সেক্ষেত্রেও তাদের আন্তরিকতার কোনো অভাব নেই। বাংলাদেশের উত্তরাঞ্চলের অধিকাংশ মানুষ নিরক্ষর হতে পারে, কিন্তু সেই নিরক্ষরতা তাদের শিল্পচেতনাকে তেমন বিঘ্নিত করতে পেরেছে বলে মনে হয় না। উত্তরাঞ্চলের ফোকলোর সংগ্রহ ও সংরক্ষণের ক্ষেত্রে বাঙালি মনীষীদের মধ্যে কবিগুরু রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর (১৮৬১-১৯৪১) সর্বপ্রথম ভূমিকা পালন করেন। এ প্রসঙ্গে প্রখ্যাত ফোকলোরবিদ ড. মযহারুল ইসলাম বলেছেন, লোকসাহিত্যের আলোচনায় সূত্রপাত করে তিনি আমাদের পথিকৃৎ হয়ে আছেন। উত্তরাঞ্চলের ফোকলোর সংগ্রহে কবিগুরুর অবদান সম্পর্কে সংক্ষেপে আলোচনা করবো, তবে তার আগে উত্তরাঞ্চলে ফোকলোর চর্চার সংক্ষিপ্ত পরিচয় তুলে ধরার প্রয়োজনীয়তা অনুভব করছি। বাংলাদেশের উত্তরাঞ্চলের ফোকলোর সংগ্রহ ও সংরক্ষণের কাজ ঠিক কখন থেকে শুরু হয়েছে আজ তা সঠিকভাবে নিরূপণ করা মোটেও সহজ কাজ নয়। ইতিহাসপাঠে জানা যায় অষ্টাদশ ও ঊনবিংশ শতাব্দীতে ব্রিটিশ প্রশাসনিক কর্মচারী ও মিশনারিরা এ অঞ্চলের সমৃদ্ধ ফোকলোরকে বিশেষভাবে উপলব্ধি করতে পেরেছিলেন, যে কারণে তাঁরা নিজেদের কাজকর্ম ছাড়াও যাদের মধ্যে বসবাস করতেন তাদের মধ্য থেকে ফোকলোরের নানা উপকরণ-সংগ্রহের কাজে আত্মনিয়োগ করেছিলেন। উত্তরাঞ্চলের ফোকলোরের নানা উপাদান সংগ্রহের ব্যাপারে ব্রিটিশ কর্মচারী ও মিশনারিরা যে অবদান রেখেছেন, আমাদের ফোকলোর সংগ্রহের ইতিহাসে তা এক গুরুত্বপূর্ণ ঘটনা।
রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের জন্ম ১৮৬১ সালের ৭ মে (২৫ বৈশাখ ১২৬৮) কলকাতার জোড়াসাঁকোয়। বাবা মহর্ষি দেবেন্দ্রনাথ। বিংশ শতাব্দীর শ্রেষ্ঠ ভারতীয় মনীষী এবং বিশ্ববিখ্যাত কবি। ছাপার অক্ষরে স্বনামে তাঁর প্রথম প্রকাশিত কবিতা ‘হিন্দু মেলার উপহার’ (৩০.১০.১২৮১ ব.)।
১৮ বছর বয়সের মধ্যে তিনি ‘বনফুল’, ‘কবিকাহিনী’, ‘ভানুসিংহের পদাবলী’, ‘শৈশব সংগীত’ ও ‘রুদ্রচণ্ডু’ রচনা করেন। ‘জ্ঞানাঙ্কুর’ পত্রিকায় প্রকাশিত ‘ভুবনমোহিনী প্রতিভা’ তাঁর প্রথম গদ্য প্রবন্ধ। ‘ভারতী’র প্রথম সংখ্যায় তাঁর প্রথম ছোটগল্প ‘ভিখারিণী’ এবং প্রথম উপন্যাস ‘করুণা’ প্রকাশিত হয়। ২২ বছর বয়সে নিজেদের জমিদারি সেরেস্তার এক কর্মচারীর একাদশবর্ষীয়া কন্যা ভবতারিণীর (পরিবর্তিত নাম মৃণালিনী) সঙ্গে তাঁর বিবাহ হয় (৯.১২.১৮৮৩)। পুত্র রথীন্দ্রনাথের শিক্ষা-সমস্যা থেকেই কবির বোলপুর ব্রহ্মচর্য আশ্রমের সৃষ্টি হয় (২২.১২.১৯০১)। সেই প্রতিষ্ঠানই আজ ‘বিশ্বভারতী বিশ্ববিদ্যালয়’-এ রূপান্তরিত হয়েছে।
১৯১২ সালের নভেম্বর মাসে গীতাঞ্জলির ইংরেজি অনুবাদ বা ‘ঝড়হম ঙভভবৎরহমং’ প্রকাশিত হয়। ১৯১৩ সালের অক্টোবরে প্রথম ভারতবাসী রবীন্দ্রনাথ সাহিত্যে নোবেল পুরস্কার লাভ করেন। কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয় তাঁকে ডক্টরেট (১৯১৪) এবং সরকার স্যার (১৯১৫) উপাধিতে ভূষিত করে।
রবীন্দ্রনাথের একক চেষ্টায় বাংলাভাষা সকল দিকে যৌবনপ্রাপ্ত হয়ে বিশ্বের দরবারে সগৌরবে নিজের আসন প্রতিষ্ঠা করেছে। কাব্য, ছোটগল্প, উপন্যাস, নাটক, প্রবন্ধ, গান প্রত্যেক বিভাগেই তাঁর অবদান অজস্র এবং অপূর্ব। তিনি একাধারে কবি, দার্শনিক, শিক্ষাবিদ, সুরকার, নাট্যপ্রযোজক এবং স্বদেশপ্রেমিক। তাঁর রচিত দুই হাজারের ওপর গানের স্বরলিপি আজো প্রকাশিত হচ্ছে। দুটি স্বাধীন রাষ্ট্রের (ভারত ও বাংলাদেশ) জাতীয় সংগীত-রচয়িতারূপে একমাত্র রবীন্দ্রনাথেরই নাম পাওয়া যায়।