রবীন্দ্রনাথের ‘চোখের বালি' উপন্যাসের বিশেষত্ব এখানেই যে, এটি গতানুগতিক কোন উপন্যাসের মতো রােমান্টিকতা ও ভাবালুতা-আশ্রিত নয় । বিনােদিনী-মহেন্দ্রসহ আশা ও বিহারী সমেত আরাে অনেকের মনস্তাত্ত্বিক জটিলতার বাস্তবভিত্তিকতা নিয়ে এটি রচিত হয়েছে। বিনােদিনী-মহেন্দ্রের যৌন জীবনের দেহ-মনােময় রহস্য রক্তিমতার মনস্তাত্ত্বিক রূপায়ণ এতে ঘটেছে।
রবীন্দ্রনাথের ‘চোখের বালি' (১৯০৩) বাংলা সাহিত্যের প্রথম সচেতন মনস্তাত্ত্বিক (Psychological) উপন্যাস। ঘটনবিন্যাস ও চরিত্র সৃজনের ক্ষেত্রে রবীন্দ্রনাথ এখানে স্বতন্ত্র স্বকীয়তার পরিচয় দিয়েছেন। মহেন্দ্র, বিনােদিনী, বিহারী ও আশা- এই চারটি চরিত্রই উপন্যাসের মৌল-দর্শনকে ধারণ করে আছে। প্রতিটি চরিত্রের স্বকীয় স্বাতন্ত্র্য উপন্যাসের কাহিনী ও চরিত্রচিত্রণকে প্রচালিত করেছে।
মহেন্দ্র ও বিনােদিনীর পরস্পরের প্রতি পরস্পরের কখনাে আকর্ষণ, কখনাে বিকর্ষণবােধউপন্যাসের ঘটনাধারাকে প্রবাহিত করেছে। বিহারীর ব্যক্তিত্বখচিত ভঙ্গি বিনােদিনীকে আকৃষ্ট করেছে। যদিও বন্ধু মহেন্দ্রের সাথে সম্পর্কের ক্ষেত্রে তার ব্যক্তিত্বময়তা খুব স্পষ্টযােগ্য নয়। বিহারীর মনে আশার প্রতি গােপন গভীর ভালােবাসা ছিলো; এটিই বিনােদিনীকে প্রচণ্ড ঈর্ষাকাতর করে তুলেছে। সেজন্য আশা ও মহেন্দ্রের জীবনবিক্ষেপে অস্থিরতা সৃষ্টিতে তৎপর হয়েছে বিনােদিনী। আশার সারল্য ও শিথিলতা মহেন্দ্র ও বিনােদিনীর অবৈধ সম্পর্ককে আরাে কাছাকাছি করেছে। বিহারীর প্রতি আশার বিবেচনাশূন্য দৃষ্টিভঙ্গিও বিহারীকে কর্ম ও জীবনক্ষেত্র হতে উন্মিলিত করেছে।
রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের জন্ম ১৮৬১ সালের ৭ মে (২৫ বৈশাখ ১২৬৮) কলকাতার জোড়াসাঁকোয়। বাবা মহর্ষি দেবেন্দ্রনাথ। বিংশ শতাব্দীর শ্রেষ্ঠ ভারতীয় মনীষী এবং বিশ্ববিখ্যাত কবি। ছাপার অক্ষরে স্বনামে তাঁর প্রথম প্রকাশিত কবিতা ‘হিন্দু মেলার উপহার’ (৩০.১০.১২৮১ ব.)।
১৮ বছর বয়সের মধ্যে তিনি ‘বনফুল’, ‘কবিকাহিনী’, ‘ভানুসিংহের পদাবলী’, ‘শৈশব সংগীত’ ও ‘রুদ্রচণ্ডু’ রচনা করেন। ‘জ্ঞানাঙ্কুর’ পত্রিকায় প্রকাশিত ‘ভুবনমোহিনী প্রতিভা’ তাঁর প্রথম গদ্য প্রবন্ধ। ‘ভারতী’র প্রথম সংখ্যায় তাঁর প্রথম ছোটগল্প ‘ভিখারিণী’ এবং প্রথম উপন্যাস ‘করুণা’ প্রকাশিত হয়। ২২ বছর বয়সে নিজেদের জমিদারি সেরেস্তার এক কর্মচারীর একাদশবর্ষীয়া কন্যা ভবতারিণীর (পরিবর্তিত নাম মৃণালিনী) সঙ্গে তাঁর বিবাহ হয় (৯.১২.১৮৮৩)। পুত্র রথীন্দ্রনাথের শিক্ষা-সমস্যা থেকেই কবির বোলপুর ব্রহ্মচর্য আশ্রমের সৃষ্টি হয় (২২.১২.১৯০১)। সেই প্রতিষ্ঠানই আজ ‘বিশ্বভারতী বিশ্ববিদ্যালয়’-এ রূপান্তরিত হয়েছে।
১৯১২ সালের নভেম্বর মাসে গীতাঞ্জলির ইংরেজি অনুবাদ বা ‘ঝড়হম ঙভভবৎরহমং’ প্রকাশিত হয়। ১৯১৩ সালের অক্টোবরে প্রথম ভারতবাসী রবীন্দ্রনাথ সাহিত্যে নোবেল পুরস্কার লাভ করেন। কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয় তাঁকে ডক্টরেট (১৯১৪) এবং সরকার স্যার (১৯১৫) উপাধিতে ভূষিত করে।
রবীন্দ্রনাথের একক চেষ্টায় বাংলাভাষা সকল দিকে যৌবনপ্রাপ্ত হয়ে বিশ্বের দরবারে সগৌরবে নিজের আসন প্রতিষ্ঠা করেছে। কাব্য, ছোটগল্প, উপন্যাস, নাটক, প্রবন্ধ, গান প্রত্যেক বিভাগেই তাঁর অবদান অজস্র এবং অপূর্ব। তিনি একাধারে কবি, দার্শনিক, শিক্ষাবিদ, সুরকার, নাট্যপ্রযোজক এবং স্বদেশপ্রেমিক। তাঁর রচিত দুই হাজারের ওপর গানের স্বরলিপি আজো প্রকাশিত হচ্ছে। দুটি স্বাধীন রাষ্ট্রের (ভারত ও বাংলাদেশ) জাতীয় সংগীত-রচয়িতারূপে একমাত্র রবীন্দ্রনাথেরই নাম পাওয়া যায়।